Hridmaajhare Shatakamal Part IV

Page 1


হৃদ-মাঝাের শতকমল (৪র্থ পর্ব) উৎসর্গ (‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’, অখণ্ড -অবলম্বনে)

সঙ্কলক ও সম্পাদনা

স্বামী ত্র্যম্বকেশানন্দ

অতি আপন, অতি প্রিয় আর মাথার মণিরূপে সর্বদা যঁার অবস্থান, তাঁর উদ্দেশ্যে গ্রন্থটি শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ নিবেদিত হল�ো৷


লেখকের নিবেদন ‘মায়ার বন্ধন কাটাতে না পারলে পার হওয়া যায় না। দেহে মায়া দেহাত্মবুদ্ধি, শেষে এটাকেও কাটতে হবে।’—শ্রীশ্রীমায়ের এই কথাটির বাস্তবায়নে উপায়রূপে শ্রীমা সারদাদেবীর মননে সময় অতিবাহিত করার ইচ্ছা প্রবল হয়৷ তাই কর�োনা-১৯ তৃতীয় ঢেউতে গৃহবন্দী জীবনের অানন্দ-সঙ্গী ছিল এই ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’ গ্রন্থটি৷ এর ফলস্বরূপ ‘হৃদ-মাঝারে শতকমল’-৪র্থ পর্ব রচিত হলো৷ ৩য় পর্বের সুবিধা ও অসুবিধার নিরিেখ ৪র্থ পর্বের মানকেও উন্নত করার চেষ্টা করেছি৷ মাতৃধ্যানের মতো এই লিপি বিন্যাসেও উপকৃত হয়েছি৷ তাই এক একটি অংশ নির্বাচন করে পুরো গ্রন্থের আলোকে তার সারমর্ম সংক্ষেপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি৷ পূর্বের মতো এ প্রকাশনাটিও ‘Online Base, From Home’-এর নীতি অবলম্বনে সমাপ্ত হয়েছে৷ প্রুফ দেখা, এডিট সবই ফ�োন মারফৎ করা হয়েছে৷ প্রধান দুইজন স্বেচ্ছােসবকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি সহজে ও এত কম সময়ে প্রকাশ করা সম্ভব হল�ো৷ তাঁদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই৷ ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’ (অখণ্ড)-এর (অষ্টম প্রকাশ, ৫৬তম পুনর্মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০২১, আশ্বিন ১৪২৮) প্রধানতঃ যঁাদের অমূল্য স্মৃতিসঞ্চয়ন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে৷ তঁারা হলেন

৺সরযুবালা, শ্রীশচন্দ্র ঘটক, শ্রীপ্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলি, শ্রীইন্দুভূষণ েসনগুপ্ত, শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, ব্রহ্মচারী অশোককৃষ্ণ, শ্রীপ্রবোধ ও শ্রীমনীন্দ্র, পূজনীয়া েযাগেন-মা, স্বামী শান্তানন্দ, স্বামী অরূপানন্দ, স্বামী ঈশানানন্দ, শ্রীনলিনবিহারী সরকার, স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, শ্রীমতী শৈলবালা চ�ৌধুরী, শ্রীমতী, শ্রীমতী সরলাদেবী, স্বামী ঋতানন্দ, স্বামী তন্ময়ানন্দ, শ্রীমহেন্দ্র গুপ্ত, শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, শ্রীমতী ক্ষীরোদবালা রায়, শ্রী প্রমুখ৷ সময়োপয�োগী ছ�োট ছ�োট অনুচ্ছেদে শ্রীমায়ের কথার এই রঙিন প্রকাশ একটি মাল্য রূেপ শ্রীশ্রীমায়ের গলায় শ�োভা বর্ধনের জন্য অর্পিত হল�ো৷ এতে ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’-এর মূল অংশ এবং সহজ কথায় তার ভাব-বিশ্লেষণ রয়েছে৷ অাজ স্বামী বিবেকানন্দের এই শুভ জন্মতিথিতে প্রকাশিত হল�ো ‘হৃদ-মাঝারে শতকমল’-৪র্থ পর্ব৷ এতে পাঠকের কোনভাবে সামান্য উপকার হলেও নিজেকে ধন্য মনে করব৷ জগতের সার্বিক কল্যাণ কামনা করি৷ ইতি স্বামী ত্র্যম্বকেশানন্দ ২৫ জানুয়াির, ২০২২ রামকৃষ্ণ মঠ, (মায়ের বাড়ি) ১ উদ্বোধন লেন, বাগবাজার কলকাতা—৭০০ ০০৩ পশ্চিমবঙ্গ, ভারত


সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

এক) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৪-৫ দুই) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৭-৮ তিন) ৺সরযুবালা, পৃঃ ১১ চার) ৺সরযুবালা, পৃঃ ১৮-১৯ পঁাচ) ৺সরযুবালা, পৃঃ ২১ ছয়) ৺সরযুবালা, পৃঃ ২৩-২৪ সাত) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৩০ আট) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৩৯ নয়) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৪২-৪৩ দশ) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৪৭-৪৮ এগার�ো) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৩ বার�ো) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৬-৫৭ তের�ো) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৮-৫৯ চ�ৌদ্দ) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৬১ পনের) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৬৮ ষ�োল) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৬৯ সতের�ো) ৺সরযুবালা, পৃঃ ৭৬ আঠের�ো) শ্রীশচন্দ্র ঘটক, পৃঃ ৮০-৮১ (১/ক)

০০১ ০০৪ ০০৬ ০০৮ ০০৯ ০১১ ০১৩ ০১৬ ০১৭ ০২০ ০২১ ০২৪ ০২৬ ০২৭ ০৩০ ০৩২ ০৩৩ ০৩৫

সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

ঊনিশ) শ্রীশচন্দ্র ঘটক, পৃঃ ৮৩ কুড়ি) শ্রীপ্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলি, পৃঃ ৮৫-৮৬ একুশ) শ্রীইন্দুভূষণ েসনগুপ্ত, পৃঃ ৮৮ বাইশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ৯২ তেইশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ৯৪ চব্বিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ৯৬ পঁচিশ) শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ৯৮ ছাব্বিশ) শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০২ সাতাশ) শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০৪-১০৫ আটাশ) শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০৮ ঊনত্রিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১১৪-১১৫ ত্রিশ) ব্রহ্মচারী অশোককৃষ্ণ, পৃঃ ১১৬ একত্রিশ) ব্রহ্মচারী অশোককৃষ্ণ, পৃঃ ১১৭ বত্রিশ) শ্রীপ্রবোধ ও শ্রীমনীন্দ্র, পৃঃ ১২০ তেত্রিশ) পূজনীয়া েযাগেন-মা, পৃঃ ১৩৪ চ�ৌত্রিশ) স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৩৯ পঁয়ত্রিশ) স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৪০ ছত্রিশ) স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৪৩

০৩৭ ০৪০ ০৪২ ০৪৩ ০৪৫ ০৪৭ ০৪৯ ০৫১ ০৫৩ ০৫৫ ০৫৮ ০৫৯ ০৬১ ০৬৩ ০৬৫ ০৬৮ ০৬৯ ০৭২

(২/খ)


সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

সঁাইত্রিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭০ ০৭৩ আটত্রিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭২-১৭৩ ০৭৫ উনচল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৪ ০৭৭ চল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৭ ০৭৯ একচল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৮ ০৮১ বিয়াল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮০ ০৮৩ তেতাল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮২ ০৮৫ চুয়াল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৪ ০৮৭ পঁয়তাল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৫ ০৮৯ ছেচল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৭-১৮৮ ০৯১ সাতচল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৯ ০৯৩ আটচল্লিশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯০ ০৯৫ উনপঞ্চাশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯২ ০৯৭ পঞ্চাশ) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯৪-১৯৫ ১০০ একান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, কথা, পৃঃ ১৯৯ ১০২ বাহান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০১ ১০৪ তিপান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৩ ১০৫ চুয়ান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৫ ১০৭ (৩/গ)

সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

পঞ্চান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৭ ছাপান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৯ সাতান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২১৫ অাটান্ন) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২১৯ ঊনষাট) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২২১ ষাট) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৩-২৩৪ একষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৫ বাষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৭-২৩৮ তেষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৯-২৪০ চ�ৌষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪১ পঁয়ষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪৩ ছেষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪৭ সাতষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫০ আটষট্টি) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫৬ ঊনসত্তর) স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫৯ সত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৩ একাত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৫ বাহাত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৯-২৭০

১০৯ ১১১ ১১৩ ১১৫ ১১৭ ১১৯ ১২১ ১২৩ ১২৫ ১২৭ ১২৯ ১৩১ ১৩৩ ১৩৫ ১৩৭ ১৩৯ ১৪১ ১৪৩

(৪/ঘ)


সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

তিয়াত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৩ চুয়াত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৫ পঁচাত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৮-২৭৯ ছিয়াত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮১-২৮২ সাতাত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৪ আটাত্তর) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৭ ঊনাশি) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৯ আশি) স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৯০ একাশি) শ্রীনলিনবিহারী সরকার, পৃঃ ২৯১ বিরাশি) শ্রীনলিনবিহারী সরকার, পৃঃ ২৯৩ তিরাশি) স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, পৃঃ ২৯৬

১৪৫ ১৪৭ ১৪৯ ১৫১ ১৫৪ ১৫৫ ১৫৭ ১৫৯ ১৬১ ১৬৩ ১৬৫

চুরাশি) শ্রীমতী শৈলবালা চ�ৌধুরী, পৃঃ ২৯৮-২৯৯

১৬৭

পঁচাশি) শ্রীমতী শৈলবালা চ�ৌধুরী, পৃঃ ৩০০ ছিয়াশি) শ্রীমতী, পৃঃ ৩০১-৩০২ সাতাশি) শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩০৩-৩০৪ অষ্টাশি) শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩০৫-৩০৬ উননব্বই) শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩১৩ নব্বই) শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩১৭

১৬৯ ১৭২ ১৭৩ ১৭৫ ১৭৭ ১৮০

(৫/ঙ)

সূচিপত্র

বিষয়

পৃষ্ঠা

একানব্বই) স্বামী ঋতানন্দ, পৃঃ ৩২৯ বিরানব্বই) স্বামী তন্ময়ানন্দ, পৃঃ ৩৩২ তিরানব্বই) শ্রীমহেন্দ্র গুপ্ত, পৃঃ ৩৩৪ চুরানব্বই) শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, পৃঃ ৩৩৭ পঁচানব্বই) শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, পৃঃ ৩৪২-৩৪৩ ছিয়ানব্বই) স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ৩৪৫ সাতানব্বই) শ্রী, পৃঃ ৩৪৮ অাটানব্বই) শ্রী, পৃঃ ৩৫১ নিরানব্বই) শ্রীমতী ক্ষীরোদবালা রায়, পৃঃ ৩৬০) একশ) শ্রীমতী ক্ষীরোদবালা রায়, পৃঃ ৩৬৮

(৬/চ)

১৮১ ১৮৩ ১৮৫ ১৮৭ ১৮৯ ১৯১ ১৯৩ ১৯৬ ১৯৮ ১৯৯


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

এক “দীক্ষার সময় শ্রীশ্রীমা স্বপ্নে প্রাপ্ত মন্ত্রের অর্থ বলে দিলেন। বললেন, “আগে ঐটি জপ করবে।” পরে তিনি আর একটি বলে দিয়ে বললেন, “শেষে এইটি জপ ও ধ্যান করবে।” মন্ত্রটির অর্থ বলবার পূর্বে মাকে কয়েক মিনিটের জন্য ধ্যানস্থ হতে দেখেছিলুম। মন্ত্র দেবার সময় আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল এবং কেন বলতে পারি না, কাঁদতে লাগলুম। মা কপালে বড় করে একটা রক্ত-চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিলেন। দক্ষিণা ও ঠাকুরের ভ�োগের জন্য কিছু টাকা দিলুম। শ্রীশ্রীমা পরে গ�োলাপ-মাকে ডেকে ভ�োগের টাকা তাঁর হাতে দিলেন। দীক্ষার সময় মাকে খুব গম্ভীর দেখলুম। পরে পূজার আসন হতে মা উঠে গেলেন। আমাকে বললেন, “তুমি খানিক ধ্যান, জপ ও প্রার্থনা কর।” আমি ঐরূপ করবার পর উঠে মাকে প্রণাম করতেই মা আশীর্বাদ করলেন—“ভক্তি লাভ হ�োক।” মনে মনে মাকে বললুম, “দেখ�ো মা, ত�োমার কথা মনে রেখ�ো, ফাঁকি দিও না যেন।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৪-৫)

শ্রীমায়ের কাছে কিভাবে দীক্ষা হতো তার একটি সুন্দর আলেখ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে৷ স্বপ্নে দীক্ষা প্রাপ্ত ভক্তটিকে তঁার বাম দিকে বসিয়ে শ্রীমা তাকে একা ঘরে আরও একটি মন্ত্র দিেলন৷ কিভাবে জপ করতে হয় ও ধ্যান করার প্রণালী সবই বলে দিলেন৷ এবার নিেজকে হাতে কলমে করতে হবে৷ েসটিও তাঁর সামনে করতে বলেছেন৷ স্বপ্নে পাওয়া মন্ত্রের অর্থ বলবার পূর্বে তিনি ধ্যানস্থা হলেন আর ঐ সময় বেশ গম্ভীরও ছিলেন৷ মন্ত্র পাওয়ার সময় ভক্তের শরীর কাঁপতে থাকল এবং কঁাদতে লাগল৷ শ্রীমা তার কপালে বড় করে রক্ত-চন্দনের ফেঁাটা পরিয়ে দিলেন৷ শ্রীমা পূজার আসন থেকে উঠে গেলেন৷ কিন্তু ভক্তকে সেখানে বসে ধ্যান, জপ ও প্রার্থনা করতে বলেছেন৷ পরে প্রণাম নিয়ে অাশীর্বাদ করে​েছন যেন তার ভক্তি লাভ হয়৷ এই যে পরম্পরাগত দীক্ষাদানের প্রণালী তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে৷ ভগবানের নাম নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে৷ শ্রীমায়ের দেখিয়ে যাওয়া পথে চলতে পারলে জন্ম সার্থক হবে—ধন্য হবে মনুষ্যজীবন ধারণ!

০০১

০০২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

দুই “মায়ের বাড়ির সামনের মাঠে নানা দেশের কতকগুল�ো স্ত্রী-পুরুষ বাস করে। নানা প্রকার কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তার মধ্যে একজনের উপপত্নী ছিল, উভয়ে একত্রেই বাস করত। ঐ উপপত্নীর কঠিন পীড়া হয়েছিল। মা ঐকথার উল্লেখ করে বললেন, “কি সেবাটাই করেছে মা, এমন দেখিনি। একেই বলে সেবা, একেই বলে টান।” এই বলে ঐরূপে তার সেবার কতই সুখ্যাতি করতে লাগলেন। উপপত্নীর সেবা! আমরা উহা দেখলে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করতুম, সন্দেহ নাই। মন্দের মধ্য হতেও ভালটুকু যে নিতে হয়, তা কি আমরা জানি! সামনের মাঠের ঘর হতে একটি দরিদ্রা হিন্দুস্থানী নারী তার রুগ্ন শিশুকে ক�োলে করে মায়ের আশীর্বাদ নিতে এসেছে। তার প্রতি মায়ের কি দয়া! আশীর্বাদ করলেন, ‘ভাল হবে।’ তারপর দুট�ো বেদানা ও কতকগুল�ো আঙুর ঠাকুরকে দেখিয়ে এনে তাকে দিতে বললেন। আমি মায়ের হাতে ঐগুল�ো এনে দিলে মা সেই নিঃস্ব রমণীটিকে দিয়ে বললেন, “ত�োমার র�োগা ছেলেকে খেতে দিও।” আহা! সে কতই খুশি হয়ে যে গেল! বারবার মাকে প্রণাম করতে ০০৩

লাগল।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৭-৮) এখানে শ্রীমায়ের দয়ার্দ্রচিত্ত দুিট ভিন্ন-ধর্মী ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে৷ মায়ের বাড়ির সামনে বিভিন্ন দেশের কতকগুলো পরিবার বাস করত৷ তাদের মধ্যে একজনের উপপত্নী ছিল৷ ‘উপপত্নী’ নাম শুেনই একটা কি রকম যেন নািসকা কুিঞ্চত ভাব এসে সাধারণে উপস্থিত হয়৷ কিন্তু েস অসুস্থা হলে তােক ঐ ব্যক্তিটি যেভাবে েসবা করেছিল তার সুখ্যাতি করেছেন শ্রীমা৷ শ্রীমা উপপত্নীকে গুরুত্ব না দিেয় অসুস্থ মানুষ হিসােব দেখে তার প্রতি আকর্ষণ ও েসবাকার্যটিকে বড় করে দেখেছেন৷ ব্যক্তিটি সমাজে নিন্দনীয় হলেও মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়নি তাই শ্রীমায়ের কাছে এটি তারিফ যোগ্য৷ অপর ঘটনাটি—দরিদ্র হিন্দুস্থানী নারীর রুগ্ন িশশুকে শ্রীমায়ের কাছে এনেছে তাঁর অাশীর্বাদ নিেত৷ শ্রীমা ‘ভাল হবে’ বলে আশীর্বাদ করেছেন এবং কিছু ফল ঠাকুরকে দেখিয়ে েসই নিঃস্ব রমণীকে দিয়ে বলেছেন— তোমার েরাগা ছেলেটিকে খেতে দিও৷ েস যারপরনাই খুশি হয়ে শ্রীমা বারবার প্রণাম করেছে৷ ০০৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তিন “একজন স্ত্রী-ভক্ত বললেন, “আমার পাঁচটি মেয়ে, মা, বে দিতে পারিনি, বড়ই ভাবনায় আছি।” শ্রীশ্রীমা—বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কি হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দাও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে। ঐ কথা শুনে আর একজন স্ত্রী-ভক্ত বললেন, “মায়ের উপর যদি ত�োমার ভক্তি-বিশ্বাস থাকে, তাহলে ঐ কর, ভাল হবে। মা যখন বলছেন তখন আর ভাবনা কি?” বলা বাহুল্য মেয়ের মায়ের এ-সব কথা মনে ধরল না। অপর একজন বললেন, “এখন ছেলে পাওয়া কঠিন, অনেক ছেলে আবার বে করতেই চায় না।” শ্রীশ্রীমা—ছেলেদের এখন জ্ঞান হচ্ছে, সংসার যে অনিত্য তা তারা বুঝতে পারছে। সংসারে যত লিপ্ত না হওয়া যায় ততই ভাল। সন্ধ্যা হয়েছে, পূজনীয়া য�োগীন-মা এসে শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে ঠাকুরের সন্ধ্যারতি করতে বসলেন। মা রাস্তার ধারের বারাণ্ডায় বসে জপধ্যান করছিলেন। পরে তিনি উঠে আসতে অপর স্ত্রী-ভক্তেরা সকলে প্রণাম করে বিদায়গ্রহণ করলেন।”

—(৺সরযুবালা, পৃঃ ১১) সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণায় সবাই নাজেহাল৷ অনেকগুলো মেয়ে হয়েছে, তােদর বিয়ে দিতে না পারায় এক স্ত্রীভক্ত শ্রীমায়ের কাছে এসে তার েসই দুঃখের কথা বলে একটা উপায় প্রার্থনা করেছেন৷ শ্রীমাও তার ভাবনা নিরসনে বলেছেন—নিেবদিতা স্কুলে লেখা পড়া শিখাতে তাতে তারা বেশ থাকবে৷ একজন তা সায় দিয়ে বললেও মেয়ের মার তা মনঃপূত হলো না৷ অপর একজন বলেছে—এখন বিবাহইচ্ছুক ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না৷ শ্রীমায়ের কি বৈরাগ্যপূর্ণ উত্তর! ছেলেদের এখন জ্ঞান হয়েছে—সংসার যে অনিত্য তা বুঝতে তারা পেরেছে৷ সংসারে লিপ্ত হওয়া কি দায়ের তাও হাড়ে হাড়ে বুঝেছে৷ তাছাড়া এতে তারা রাতে ঘুমিয়ে বাঁচবে৷ কিন্তু যারা বিবাহ করতে চায়, তাদেরও তিনি নিরুৎসাহিত করেন নি৷ বলেছেন, সবই তো দুটি দুটি, দুটি হাত, দুিট পা, েতমনি সংসােরও স্বামী এবং স্ত্রী৷ তার পরেই শ্রীমা নিত্য নিয়মিত সন্ধ্যারতি ও জপধ্যানাদি করেছেন৷ এই নিয়মমাফিক জীবনযাপনও সাধারণের কাছে নজীর হয়ে থাকবে৷

০০৫

০০৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চার “সে কি, নলিনী খেতে দিস্ নি? বলে গেলুম।” নলিনী (লজ্জিতভাবে)—মনে ছিল না, এই দিচ্চি। মা—না থাক এখন আর ত�োকে দিতে হবে না, আমিই দিচ্চি। (আমার প্রতি) তুমি চেয়ে খাও নি কেন, মা? এ যে নিজের বাড়ি। আমি বললুম, “তেমন খিদে পেলে চেয়ে খেতুম বই কি, মা।” মা তাড়াতাড়ি নিজেই কিছু প্রসাদী মিষ্টি এনে দিলেন। আমি আনন্দের সহিত খেলুম। ‘পান দি’ বলে সাজা পান আনতে গেলেন। নলিনী দিদি বললেন, “ব�োগন�োতে আর পান সাজা নেই, দেবে কি?” কিন্তু পুনরায় খুঁজতে গিয়ে মা তাতেই দুটি সাজা পান পেয়ে আমার হাতে দিলেন। আমি প্রণাম করে বিদায় চাইতে “এস মা, আবার এস, দুর্গা, দুর্গা” বলে উঠে বললেন, “আমি সঙ্গে যাব কি? একলা নেমে যেতে পারবে? রাত হয়েছে।” আমি বললুম, “খুব পারব মা, আপনাকে আসতে হবে না।” মা তবু ‘দুর্গা, দুর্গা’ বলতে বলতে সহাস্য মুখে সিঁড়ি পর্যন্ত এসে দাঁড়ালেন; আমি বললুম, “আর দাঁড়াতে হবে ০০৭

না মা, আমি বেশ যেতে পারব।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ১৮-১৯) শ্রীমােয়র আপন করে নেওয়ার স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা এই ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত হয়ে৷ নলিনীকে এক ভক্তকে খেতে দিতে বলে শ্রীমা অন্য কাজে গিেয়ছিলেন৷ ফিরে এসে দেখেছেন, নলিনী খে​েত দিেত ভুলে গেছে৷ তখন শ্রীমা ব্যস্ত হয়ে তােক নিেজর হাতে খেতে দিচ্ছেন এবং নিজের বািড় মনে করে েকন েস চেয়ে খায়নি তার জন্য অনুযোগ করেছেন৷ খাওয়ার পর ‘পান দি’ বলাতে নলিনী জানায় বোগনাতে সাজা পান নেই৷ শ্রীমা খুঁজে দেখলেন তােতই দুিট পান রয়েছে৷ তাই দিলেন তাকে৷ প্রণাম করে বিদায় নিতে চাইলে শ্রীমা ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে িসঁড়ি পর্যন্ত সঙ্গে গেলেন৷ এই যে অতিথিকে অাত্মীয়জ্ঞানে একটু এগিয়ে দেওয়া এতে করেই তাঁর স্বজনপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়৷ ভক্ত শ্রীমা অনন্য আকর্ষণে দেখতে েদখতে বিদায় নিচ্ছেন, শ্রীমাও তাঁর ভক্তকে প্রিয়ভাজনরূপে বিদায় জানাচ্ছেন৷ এইভাবে পরকে অাপন করার িশক্ষা জীবনে প্রতিফলিত করতে পারলেই সংসাের কল্যাণ ৈব অকল্যাণ হয় না৷ ০০৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁাচ “তখন মা বললেন, “তিনি (ত�োমার গুরু) যদি সর্বজ্ঞ হতেন—এই দেখ ত�োমার জিদের ফল, কথায় কথা বেরুল— তা হলে ঐ কথা বলতেন না। সেই আদিকাল হতে কত ল�োকে মূর্তি উপাসনা করে মুক্তি পেয়ে আসছে, সেটা কিছু নয়? আমাদের ঠাকুরের ওরূপ সঙ্কীর্ণ ভেদবুদ্ধি ছিল না। ব্রহ্ম সকল বস্তুতেই আছেন। তবে কি জান—সাধুপুরুষেরা সব আসেন মানুষকে পথ দেখাতে, এক এক জনে এক এক রকমের ব�োল বলেন। পথ অনেক, সেজন্য তাঁদের সকলের কথাই সত্য। যেমন একটা গাছে সাদা, কাল�ো, লাল নানা রকমের পাখি এসে বসে, হরেক রকমের ব�োল বলছে। শুনতে ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকলগুলিকে আমরা পাখির ব�োল বলি—একটাই পাখির ব�োল আর অন্যগুল�ো পাখির ব�োল নয় এরূপ বলি না।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ২১) অজ্ঞানতা সঙ্কীর্ণতাবশতঃ ভগবান সম্বন্ধে নানা জনে নানা কথা বলে থাকেন৷ মূর্তি উপাসনা আদিকাল থেকে তার পদ্ধতি মেনে চলে আসছে৷ তা নিয়ে কেউ যদি িবরূপ মন্তব্য করে থাকেন, তা কি আর সত্য হয়ে দঁাড়ায়? মূর্তি উপাসনা করে

কত জনই তো মুক্তি পেয়ে​েছন৷ ঠাকুরের ভেদ বুিদ্ধ িছল না৷ সঙ্কীর্ণভাব বর্জিত বলেই তঁার সব বস্তুতে ব্রহ্ম দর্শন হতো৷ সাধু পু​ুরুষেরা বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ হয়ে তাঁদের মত প্রচার করেছেন৷ একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়ে এ ব্যাপারটি েবাঝানো হয়েছে৷ একটি গাছে লাল, নীল, সবুজ পািখ বসে তাদের বোল বলে চলেছে৷ পৃথক পৃথক হলেও আমরা সবগুলিেক ‘পািখর বোল’ বলি৷ একটা পাখির বোল অন্যগুল�ো পাখির ব�োল নয় এরূপ বলি না। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে ঠাকুর অনেক ঘটনা গল্পাকারে বলেছেন৷ যেমন একটি পুকুরে অনেক ঘাট রয়ে​েছ৷ কোন ঘােট িহন্দুরা জল নেয়, তারা বলে জল; মুসলমানেরা সেই জলকে বলে পানি; খ্রিষ্টানেরা েসই জলকেই বলে ওয়াটার৷ তবু জল একই থাকে৷ েসইরূপ ভগবান এক৷ তাঁকে নানা নামে নানাভাবে ডাকে৷ অথবা বাবােক ছোট ছেলে যদি বাবা না বলে পা পা বলে তবে তিনি িক েসই ডাকে সাড়া েদবেন না? তাই ঈশ্বরকে যে যে নামেই ডাকুক, তিনি সবার সব কথা শোেনন ও বোঝেন এবং সেই ভাবেই তাদের রক্ষা করেন, আবার পথ দেখিয়ে অভীষ্ট পূরণ করেন৷

০০৯

০১০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছয় “তারপর কথাপ্রসঙ্গে গ�ৌরীমা ও দুর্গাদেবীর কথা উঠল। মা উভয়ের অনেক সুখ্যাতি করলেন। আর বললেন, “দেখ, মা, চড় খেয়ে রামনাম অনেকেই বলে, কিন্তু শৈশব হতে ফুলের মত�ো মনটি যে ঠাকুরের পায়ে দিতে পারে, সে-ই ধন্য। মেয়েটি যেন অনাঘ্রাত ফুল। গ�ৌরীদাসী মেয়েটিকে কেমন তৈরি করেছে! ভায়েরা বিয়ে দেবার বহু চেষ্টা করেছিল! গ�ৌরীদাসী ওকে লুকিয়ে হেথা সেথা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। শেষে পুরী গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে মালা বদল করে সন্ন্যাসিনী করে দিলে। সতী লক্ষ্মী মেয়ে, কেমন লেখাপড়াও শিখেছে! কি একটা সংস্কৃত পরীক্ষাও দেবে শুনছি।” গ�ৌরীমার পূর্বজীবন সম্বন্ধেও অনেক কথা বললেন। তাতে জানলুম, তাঁর জীবনের উপর দিয়ে কম দুঃখ-ঝঞ্ঝা বয়ে যায়নি। কাশীর কথা ওঠাতে বললেন, “কাশীতে বেশ ছিলুম গ�ো, আর আমি ত�ো সঙ্গে করে যদুবংশ সব নিয়ে গিয়েছিলুম, মা।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ২৩-২৪) অনাঘ্রাত ফুলই দেবতার পূজায় লাগে৷ গ�ৌরীদাসীর

কথায় শ্রীমা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন৷ একটি েময়ে​েক তার ভায়েরা বিয়ে দিেত চেয়েছিল, মেয়েটির অমতে৷ কিন্তু েস গ�ৌরীদাসী শরণাগত হলে তিনি তাকে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রে​েখ, ঐ বিয়ে থে​েক রক্ষা করেন৷ পরে পুরীতে গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে মালা বদল করে তাকে সন্ন্যািসনী করে দিয়েছেন৷ শ্রীমা বড়ই খুশি৷ ঐ মেয়েিট সতী লক্ষ্মী এবং লেখাপড়াও শিখেছে! মেয়েরা গৃহস্থ জীবনের মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলে শ্রীমা অানন্দ পেতেন৷ তাদের প্রাণভরে অাশীর্বাদ করতেন৷ সংসার থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানকে নিয়ে জীবনযাপন করার সুন্দর প্রয়াসকে উৎসাহিত করতেন৷ আবার তিনি বিদ্যোৎসাহীও ছিলেন৷ মেয়েরা িশক্ষিত হলে তাদের জীবন সুন্দর হয়৷ তখন নিেজদের ভালমন্দ নিজেরা বুঝতে পারে৷ অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিেজদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারে৷ পাড়াগঁায়ের মেয়েদের দুঃখ দুর্দশা বিষয়ে শ্রীমায়ের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা ছিল৷

০১১

০১২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাত “পরে কথাপ্রসঙ্গে বলতে লাগলেন, “শ�োন, মা, বিধাতা যখন প্রথম মানুষ সৃষ্টি করলেন, তখন একপ্রকার সত্ত্বগুণী করেই করলেন। ফলে তারা জ্ঞান নিয়ে জন্মাল, সংসারটা যে অনিত্য তা বুঝতে আর তাদের দেরি হল�ো না। সুতরাং তখনি তারা সব ভগবানের নাম নিয়ে তপস্যা করতে বেরিয়ে পড়ল এবং তাঁর মুক্তিপদে লীন হয়ে গেল। বিধাতা দেখলেন, তবে ত�ো হল�ো না। এদের দিয়ে ত�ো সংসারের লীলা-খেলা কিছু করা চলল না। তখন সত্ত্বের সঙ্গে রজঃ তমঃ অধিক করে মিশিয়ে মানুষ সৃষ্টি করলেন। এবার লীলাখেলা চলল ভাল।” এই পর্যন্ত বলে সৃষ্টিপ্রকরণ সম্বন্ধে সুন্দর একটি ছড়া বললেন। তারপর বললেন, “তখন, মা, যাত্রা কথকতা এই সব ছিল। আমরা কত শুনেছি, এখন আর তেমনটি শ�োনা যায় না।” ইতিমধ্যে কাল�ো-বউ অন্য ঘরে উঠে গিয়ে নলিনীদিদি ও মাকুর কাছে কি একখানা বই চেঁচিয়ে পড়ছিল। মা তাই শুনে বললেন, “দেখছ মা, অত চেঁচিয়ে পড়ছে, নিচে সব কত ল�োক রয়েছে, তা হুঁশ নেই?” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৩০) শ্রীমা সৃষ্টিপ্রকরণ সম্বন্ধে বলেছেন, ভগবান যখন মানুষ

সৃষ্টি করলেন, তখন সত্ত্বগুণী করে ৈতরি করলেন৷ জন্মেই তারা জ্ঞান প্রাপ্ত হলো েয এ সংসারটা অনিত্য৷ তাই তারা ভগবানের ধ্যােন তপস্যার বেিরয়ে পড়ল এবং অচিের মুক্তিপ্রাপ্ত হলো৷ ভগবান দেখলেন এতে করে তার সৃষ্ট রাজ্যে লীলােখলা জমছে না৷ তখন তিনি সত্ত্বের সঙ্গে েবশি করে রজ ও তম গুণ িমশিয়ে দিলেন, তখন দিব্য ভগবানকে ভুলে সংসারকে নিত্য জ্ঞান করে লীলা খেলা চলতে লাগল৷ তারই ফল আমরা েবশির ভাগ মানুষ ভগবানকে ভুলে েবশ দিব্য আছি ভেবে সংসার যাত্রা নির্বাহ নিয়ে সুখে দুঃেখ আনন্দে আছি৷ একটাকা সুখ বা দুঃখ তাই অনুভব করি না৷ মিলে মিশে থাকায় সব রকমই অনুভব হচ্ছে৷ এই রহস্য েজনে েকান েকান ভাগ্যবান তাই আজই মুিক্তলাভ করে চলেছে৷ এই সব কথা হলেও আবার পুনরায় েসই সংসারের কর্তব্যকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সকলে৷ শ্রীমাও অন্য প্রসঙ্গ করে যেন এই সৃষ্টিপ্রকরণ ভুলে িত্রগুণাতীত হয়েও যেন রজ ও তমগুণের প্রাধ্যােনরই কথাবার্তা বলতে লাগলেন৷ বাস্তবিকই তাই হয়ে থাকে, সব জেনেও এই সংসারের মায়ায় েমািহত হয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ হতে থাকে৷

০১৩

০১৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আট “মা—কৈ, মা, ক�োথায় আটচালা? অমনি চালাঘর। শরতের বইয়ে সব ঠিক ঠিক লিখেছে। মাস্টারের বইও বেশ—যেন ঠাকুরের কথাগুলি বসিয়ে দিয়েছে। কি মিষ্টি কথা! শুনেছি, ঐ রকম বই আরও চার-পাঁচ খণ্ড হতে পারে এমন আছে। তা এখন বুড়�ো হয়েছে, আর পারবে কি? বই বিক্রি করে অনেক টাকাও পেয়েছে—শুনেছি সে টাকা সব জমা রেখেছে। আমাকে জয়রামবাটীতে বাড়িটাড়ি করতে প্রায় এক হাজার টাকা দিয়েছে (বাড়ির জন্য ৪০০৲ ও খরচের জন্য ৫৩০৲) আর মাসে মাসে আমাকে দশ টাকা দেয়। এখানে থাকলে কখন�ো কখন�ো বেশি—বিশ পঁচিশ টাকাও দেয়। আগে যখন স্কুলে চাকরি করত, তখন মাসে দুটাকা করে দিত। আমি—গিরিশবাবু না-কি মঠে অনেক টাকা দিয়েছেন? মা—সে আর কি দিয়েছে? বরাবর দিয়েছিল বটে সুরেশ মিত্তির। তবে হ্যাঁ, কতক কতক দিয়েছে বই কি। আর আমাকে দেড় বছর রেখেছিল বেলুড়ে নীলাম্বরের বাড়িতে। দুহাজার, পাঁচ হাজার মঠে যে দিয়েছে তা নয়। দেবেই বা ক�োত্থেকে? তেমন টাকাই বা ক�োথা ছিল? আগে ত�ো ০১৫

পাষণ্ড ছিল, অসত্সঙ্গে থিয়েটার করে বেড়াত। বড় বিশ্বাসী ছিল, তাই ঠাকুরের অত কৃপা পেয়েছিল।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৩৯) ঠাকুর মা স্বামীজী কোন কথাকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করতে হলে পুস্তকের কথাই মেনে নিতে হয়৷ শ্রীমায়ের জীবিত অবস্থায়ই অনে​েক অনেক বই লিখে ফেলেছে, কিন্তু প্রামাণ্য জীবনী েকবল শরৎ মহারাজ এবং মাস্টারের বই ছাড়া অন্য বই িবশ্বাসযোগ্য নয়৷ প্রসঙ্গক্রমে মাস্টার অনেক টাকা দিয়েছে জয়রামবাটীেত৷ বািড় ইত্যাদিতে হাজার টাকা৷ জয়রামবাটীতে থাকলে মাসে মাসে দশ-বিশপঁচিশ টাকা দিত৷ স্কুলে চাকরি করার সময় মাসে মাসে দুটাকা দিত৷ টাকা দেওয়া প্রসঙ্গে িগরিশবাবু কথা উঠেছে৷ শ্রীমা বলেছেন গি​িরশবাবুর টাকা দেওয়ার ক্ষমতা েতমন িছল না, তবুও দিয়েছে৷ কোথা থেকে বেশি দেবে? পাষণ্ড ছিল, অসৎসঙ্গে িথয়েটার করে বেড়াত৷ বরবার বেিশ দিেয়ছে এসেছে সুরেশ মিত্তির৷

০১৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

নয় “বাবুরাম তার মাকে বলত, ‘তুমি আমাকে কি ভালবাস! ঠাকুর আমাদের যেমন ভালবাসেন, তুমি তেমন ভালবাসতে জান না।’ সে বলত, ‘আমি মা, আমি ভালবাসি না, বলিস কিরে?’ এমনি তাঁর ভালবাসা ছিল। বাবুরাম চার বছরের সময়ই বলত, ‘আমি বে করব না—বে দিলে মরে যাব।’ ঠাকুর যখন বলেছিলেন, ‘আমি পরে সূক্ষ্ম শরীরে লক্ষ মুখে খাব,’ বাবুরাম বলেছিল, ‘ত�োমার লক্ষ-টক্ষ আমি চাই নে, আমি চাই তুমি এই মুখটিতে খাবে, আর আমি এই মুখটিই দেখব।’ “অনেকগুল�ো ছেলেপিলে হয় যার, ঠাকুর তাকে গ্রহণ করতেন না। একটা দেহ হতে পঁচিশটা ছেলে বেরুচ্ছে, ওরা কি মানুষ! সংযম নেই, কিছু নেই—যেন পশু!” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৪২-৪৩) ভালবাসা প্রসঙ্গে কথা উঠেছে৷ বাবুরাম তার গর্ভধারিণীকে পর্যন্ত বলেছে, তুিম কি আর আমাকে ভালবাস, ঠাকুর এর থেকে অনেক বেিশ ভালবাসেন৷ মা হয়ে কি করে বিশ্বাস করবে েয মায়ের ভালবাসাকেও ঠাকুরের ভালবাসা হার মানায়? ভালবাসার খনিস্বরূপ তো তাই হবে৷ যার থেকে ০১৭

ভালবাসা সৃষ্টি হয়, েসই সৃষ্টির স্বরূপ তিনি৷ বাবুরাম খুব েছাটবেলায় বলত, ‘আমি বে করব না—বে দিলে মরে যাব।’ কি শুভ সংস্কার না ছিল৷ তাই তো তাকে হাড়শুদ্ধ শুদ্ধ বলা হয়ে​েছ৷ ঠাকুর যখন বলেছিলেন, ‘আমি পরে সূক্ষ্ম শরীরে লক্ষ মুখে খাব,’ বাবুরাম বলেছিল, ‘ত�োমার লক্ষ-টক্ষ আমি চাই নে, আমি চাই তুমি এই মুখটিতে খাবে, আর আমি এই মুখটিই দেখব।’ কি সুন্দর কথোপকথন! লক্ষ-টক্ষ নয়, এই মুেখই খাবে এই এই মুখই দেখব৷ বাস্তবিক সূক্ষ জগৎ ইত্যাদি েকতাবী ভাষায় মন ভরে না৷ চাক্ষুষ ছঁুয়ে দেখব, সাদা েচাখে দেখব—এই-ই কাম্য৷ সংসারে যাদের অনেকগুিল েছলেপুলে ছিল, তাদের ঠাকুর গ্রহণ করতে পারতেন না৷ বলতেন একটু সংযম নেই৷ একটা দেহ হতে পঁিচশটা ছেলে েবরুচ্ছে—পশুবৎ জীবন! ঠাকুরের কথা একটি দুটি ছেলের পর ভাই েবানের মত থাকবে৷ েস দিন এখন আর নেই৷ সত্যি এখন একটি বা দুটি সন্তানের পর অনেকেই ভাই েবানের মতই থাকে৷ যে কোন আর্থসামাজিক কারণেই হোক না কেন, ঠাকুরের েসই মহতী ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয়েছে এখন৷ ০১৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

দশ “নলিনীদিদি বললেন, “তুমি চাও কেন, তাই ত�ো নিয়ে আসে।” মা বললেন, “তা, ওদের কাছে চাইব না—আমার মেয়ে? আর এটা কি কম স�ৌভাগ্যের কথা! কি বল, মা?” আজ অনেক রাত্রি হতে তবে গিয়েছিলুম। ভ�োগের পর প্রসাদ নিয়ে বাড়ি আসবার সময় বললুম, “কাল ব�োধ হয় আসা হবে না, মা, এক বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে।” —“আচ্ছা, তা কাল না এলে ভাবব বিয়ে বাড়ি গেছ।” ঘিটা সেদিন ভাল ছিল না; “ভাজা জিনিসগুল�ো তেমন ভাল হয়নি”—মা বলতে আর একদিন ভাল ঘিয়ে কয়েক রকম খাবার, পিঠে, ডাল ও তরকারি রেঁধে নিয়ে গিয়েছিলুম। খেয়ে মা খুব আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। মায়ের ভাইঝি নলিনীদিদির একটু শুচিবাই ছিল। তিনিও সেদিন ঐ সব খাবার খেয়ে বলেছিলেন, “আমার ত�ো কারুর রান্না র�োচে না, কিন্তু এর হাতে খেতে ত�ো ঘেন্না হচ্ছে না!” মা বললেন, “কেন হবে?—ও যে আমার মেয়ে।” পরে আমাকে বলছেন, “দ্যাখ, সেদিন যে কচুশাকের অম্বল দিয়েছিলে, তা আমাকে ওরা দেয়নি।” ০১৯

—(৺সরযুবালা, পৃঃ ৪৭-৪৮) খুব ঘরোয়া কথাবার্তােতও শ্রীমাকে অনন্য সাধারণ বলে মনে হয়৷ শ্রীমা যাদের অাপন করে নিতেন, তাদের কাছে কোন জিনিস চাইতে দ্বিধাবোধ করতেন না৷ এমনই একজনকে কিছু রান্না করে নিয়ে আসতে বলেিছলেন৷ িতনি নিয়েও এসেিছলেন, কিন্তু ঘি খারাপ থাকায় েস দিনের রান্না করা জিনিস ভাল হয়নি বলে আবার একবার তাই রান্না করে নিয়ে এসেছে৷ এ প্রসঙ্গ শ্রীমায়ের ভাইঝি নলিনীদিদি শ্রীমােক কটাক্ষ করে বলেছেন, তুমি কেন চাও? শ্রীমা জানিয়েছেন, ও আমার মেয়ে, ওকে চাইতেই পাির৷ েসই রান্না করা খাবার এমন শুিচবায়ুগ্রস্থ হয়েও েখয়েছে এবং বলে​েছ, ‘আমার ত�ো কারুর রান্না র�োচে না, কিন্তু এর হাতে খেতে ত�ো ঘেন্না হচ্ছে না! মা বললেন, ‘কেন হবে?—ও যে আমার মেয়ে।’ এমন সার্টিফিকেট কি সবার কপালে েজােট? ধন্য শ্রীমায়ের এমন মেয়েিট! বালিকার মতো আবার শ্রীমা বলেছেন, ‘দ্যাখ, সেদিন যে কচুশাকের অম্বল দিয়েছিলে, তা আমাকে ওরা দেয়নি।’ কি আপন না হলে এমন কথা েকউ বলতে পারে! ০২০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

এগার�ো “সব ল�োকের জ্বালা-তাপে শরীর জ্বলে গেল, মা!”—এই বলে গায়ের কাপড় ফেলে মা শুলেন। আমি তেল মালিশ করবার উদ্যোগ করছি এমন সময় আবার মহিলাটির কে আত্মীয় (সঙ্গে এসেছেন) প্রণাম করতে এলেন। আবার মাকে উঠতে হল�ো। তিনি চলে যেতে মা পুনরায় শুয়ে বললেন, “এবার যেই আসুক আমি আর উঠছি নে। পায়ের ব্যথায় বারবার উঠতে কত কষ্ট দেখছ ত�ো, মা! তারপর আমবাতের জ্বালায় সারা পিঠটা এমন করছে। বেশ করে তেলটা ঘষে ঘষে দাও ত�ো।” তেল মালিশ করবার সময় পূর্বোক্ত মহিলাটির কথা উঠায় মা বললেন, “অমন বিপদ, ঠাকুরের কাছে এসেছে, মাথা মুড়, খুঁড়ে মানসিক করে যাবে—তা নয়, কি সব গন্ধটন্ধ মেখে কেমন করে এসেছে দেখেছ? অমন করে কি ঠাকুরদেবতার স্থানে আসতে হয়? এখনকার সবই কেমন এক রকম!” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৩) শ্রীমায়ের কাছে নানান ধরনের মানুষ আসত। তারা তাঁকে প্রণাম করত; কিন্তু শ্রীমা সবার প্রণাম নিয়ে খুশি হতে পারতেন না। কেউ প্রণাম করলে তাঁর প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। আবার ০২১

কেউ বা প্রণাম করলেই গা জ্বলে যেত। নানা কামনা বাসনা নিয়ে প্রণাম করে। তাদের পাপতাপ নিয়ে শরীরে জ্বালা অনুভব করেন। বেশি অসহ্য হলে গঙ্গা জলে পা ধুয়ে দিতেন।ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় তেল মালিস করিয়ে নিতেন। মানুষের আর দ�োষ কি ? তারা ত�ো দ�োষে গুণে ভরা। আর শ্রীমা দেবী হয়ে তা গ্রহণ না করলে কে করবে ? সবই নিতে হয়;আবার তার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। জেনে-শুনে পাপ করা হয় অজান্তে পাপ হয়ে যাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সংস্কারের ধারণায় এমন হয়ে থাকে। পূর্বজীবনের শুভ সংস্কার থাকলে ঈশ্বরের সহজে মতি হয়। আর না থাকলে ঠিক তার বিপরীত হয়। ভগবানের নাম নিলে মনের শান্তি, পবিত্রতা বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছা না হলে গাছের পাতাও নড়ে না। তাহলে আর দ�োষ কাদের? ঈশ্বর লীলা করেন, মানুষের কষ্ট হয়। ভগবানের লীলা মানুষের খেলা হতে পারে না। যেমন কিনা ছেলেরা বানরদের ঢিল ছুড়ে মেরে খেলা করে কিন্তু বানরদের কষ্ট হয়। এমনিভাবে ঈশ্বরের লীলা আর মানুষের কষ্ট স্বীকার এ কি কথা! ০২২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বার�ো “মা রাস্তার ধারের বারাণ্ডায় গিয়ে হাসতে হাসতে ডাকছেন, “ও মেয়ে, ও মেয়ে একবার এদিকে এস, শিগ্‌গির এস।” আমি কাছে যেতেই বলছেন, “দেখ, দেখ ঐ বেশ্যাবাড়ির সামনে জানালার ধারে একটা ল�োক, একবার এ-জানালা একবার ও-জানালা করে মরছে—ঢুকতে পারছে না। দেখ, কি ম�োহ, কি প্রবৃত্তি! ভিতর থেকে ঐ গানের শব্দ আসছে, আর ও ঢুকতে পারছে না। আহা! মল�ো গ�ো ছট্‌ফটিয়ে।” মা এমনি করে কথাগুলি বলছেন যে, হাসি চাপতে পারলুম না। তখন মাও হাসেন, আমিও হাসি। হাসতে হাসতে দুজনের ঘরে এলুম। আমি—আহা! ভগবানের জন্যে যদি ঐরূপ ছট্‌ফটানিটুকু হয়। তা হয় না, মা! একটি মেয়ের কথা উঠল। মা বললেন, “কি ম�োহ হয়েছে, মা, ওর স্বামীর জন্যে! খেয়ে শুয়ে সুস্থির নেই, খেতে খেতে উঠে গিয়ে দেখে আসে। দিনরাত ঘরে বন্দী করে নিয়ে বসে আছে। ওর জন্যে সে ত�ো ক�োন জায়গায় বেরুতে পর্যন্ত পারে না। ছি! ছি!! আর শরীর কি হচ্ছে দেখ! একটা ছেলে টেলে হলে যদি ওর এই ভাব কমে।” ০২৩

—(৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৬-৫৭) শ্রীমা বলেছেন কি দেহাসক্তি সাধারণ মানুষের। বেশ্যা বাড়িেত গান-বাজনা হচ্ছে, একটি ল�োক ভেতরে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তার কষ্ট দেখে শ্রীমা একজনকে ডেকে তা দেখাচ্ছেন এবং উভয়েই হাসছেন। শরীরের প্রতি কি ম�োহ এবং তাতে আবদ্ধ জীব। এর হাত থেকে বের হতে পারছে না। নিজেকে তৃতীয় সত্তায় ভাগ করে নিতে পারলে এ অবস্থাটি বুঝতে পারবে। যে শরীরের প্রতি এত ম�োহ তা বিচার করলে এর প্রকৃত সত্যকে অনুভব করলে বের হতে পারবে৷ যে শরীরে এত ম�োহ তা বিচার করলে কি পাওয়া যায়? মল-মূত্র পূরিষাদিতে ভর্তি মলভাণ্ডমাত্র। তাতে আবার আসক্তি? ভগবানের কৃপা হলেই এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে৷ আবার শ্রীমা বলেছেন, একটি দুটি সন্তান হলে এই অবস্থা একটু প্রশমিত হতে পারে। জীবন দর্শন সূক্ষ্মভাবে অনুভব করতে পারলে এই ভাব কাটবে৷ ভগবানের কাছে শরণাগত হয়ে প্রার্থনা করলে, তিনি কৃপা করে এই হীনদশা থেকে উচ্চ অবস্থাতে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন। এর জন্য আন্তরিকভাবে ভগবানকে ধরে থাকতে হয়। ০২৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

েতর�ো “মা—সে কি বাছা, ও কথা কি ভাবতে আছে? দর্শন কি র�োজই হয়? ঠাকুর বলতেন, “ছিপ ফেলে বসলেই কি র�োজই রুই মাছ পড়ে? অনেক মাল-মসলা নিয়ে একাগ্র হয়ে বসলে ক�োন দিন বা একটা রুই এসে পড়ল, ক�োন দিন বা নাই পড়ল, তাই বলে বসা ছেড়�ো না।” জপ বাড়িয়ে দাও। য�োগীন-মা—হ্যাঁ, নামব্রহ্ম। প্রথম প্রথম মন একাগ্র না হলেও হবে নিশ্চয়। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, “কত সংখ্যা জপ করব আপনি বলে দিন, মা, তবে যদি মনে একাগ্রতা আসে।” মা—আচ্ছা, র�োজ দশ হাজার কর�ো, দশ হাজার—বিশ হাজার, যা পার। সন্ন্যাসী—মা, একদিন সেখানে ঠাকুরঘরে পড়ে কাঁদছি, এমন সময় দেখলুম, আপনি মাথার পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘তুই কি চাস?’ আমি বললুম, ‘মা, আমি আপনার কৃপা চাই, যেমন সুরথকে করেছিলেন।’ আবার বললুম, ‘না, মা, সে ত�ো দুর্গারূপে; আমি সেইরূপে চাই না, এইরূপে!’”

—(৺সরযুবালা, পৃঃ ৫৮-৫৯) শ্রীমায়ের সঙ্গে সন্ন্যাসী সন্তানের প্রতিদিন কেন ঠাকুরের দর্শন পায় না—এ বিষয়ে কথ�োপকথন হচ্ছে। শ্রীমা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তাকে উদাহরণ দিয়ে ব�োঝান�োর চেষ্টা করেছেন। মাছ ধরার জন্য ছিপ নিয়ে বসলেই কি আর র�োজ মাছ পড়ে? আচার করে, ছিপ ফেলে বসে থাকতে হয় কখন ফাৎনা ডুবে। খুব একাগ্র মনে ভগবানের চিন্তা করতে হয়। তিনি কৃপা করলে তাঁর দর্শন পাওয়া যায়। তবুও অভ্যাস ছাড়লে চলবে না। নিয়ম করে র�োজ জপ করে যেতে বলেছেন। কত সংখ্যক জিজ্ঞাসা করলে, বলেন, দশ হাজার বা বিশ হাজার অথবা যা পারা যায়। জ�োর দিয়ে কখনই বলছেন না যে, এত হাজার জপ করতেই হবে, জ�োর দিচ্ছেন, প্রতিদিন জপ করতে। সর্বক্ষণই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জপ করার অভ্যাস করলে ঈশ্বর তন্ময়তায় ডুবে থাকা যায়। সন্ন্যাসীর এক দিনের বিশেষ অনুভূতি হয়েছে। তাঁ নিঃসঙ্কোচে বলেছেন, শ্রীমাকে দুর্গা রূপে পেতে চাইছেন না, এই সারদারূপেই যাতে তার অবাধ দর্শন হয় তার জন্য নিবেদন করেছেন। সবরূপই এক হলেও এই রামকৃষ্ণ বা সারদারূপই সন্ন্যাসীর কাছেই কাম্য।

০২৫

০২৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চ�ৌদ্দ “আমি—আচ্ছা, মা, সংসারে ত�ো স্ত্রীল�োকদের স্বামী একান্ত পূজ্য ও গুরু। তাঁর সেবায় সাল�োক্য, সাযুজ্য পর্যন্ত মিলে থাকে—শাস্ত্রে বলে। সেই স্বামীর কতকটা মতের বিরুদ্ধে ক�োন স্ত্রী যদি অনুনয়-বিনয় বা সদালাপ দ্বারা সংযমী হয়ে থাকতে চেষ্টা করে তাতে কি পাপ হয়? মা—ভগবানের জন্য হলে ক�োন পাপ হয় না, মা। কেন হবে? ইন্দ্রিয়সংযম চাই, এই যে বিধবাদের এত ব্যবস্থা সব ইন্দ্রিয়সংযমের জন্যে। ঠাকুরের ক�োন বিষয়ই ভগবান ছাড়া ছিল না। আমাকে যে-সব জিনিস দিয়ে ষ�োড়শীপূজা করেছিলেন সেই সব শাঁখা শাড়ী ইত্যাদি—আমার ত�ো গুরু-মা ছিলেন না—কি করব ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি ভেবে বললেন, ‘তা ত�োমার গর্ভধারিণী মাকে দিতে পার’—তখন বাবা বেঁচে ছিলেন—‘কিন্তু দেখ�ো তাঁকে যেন মানুষজ্ঞান করে দিও না, সাক্ষাৎ জগদম্বা ভেবে দেবে।’ তাই করলুম; এমনি শিক্ষা তাঁর ছিল।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৬১) শ্রীমায়ের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে, স্বামীর সেবা পরম ধর্ম হলেও স্ত্রী যদি স্বামীর অমতে সংযম অভ্যাস করে,

তাহলে কি তার অধ�োগতি হবে? শ্রীমা উত্তরে বলেন, ভগবানের জন্য করলে ক�োন দ�োষের নয়। বিধবাদের সংযম অভ্যাসের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। তাঁর নিজের জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। ঠাকুরের ক�োন বিষয়ই ভগবান ছাড়া ছিল না। তাঁকে ষ�োড়শী পূজাতে যেসব শাঁখা, শাড়ি দিয়েছিলেন তার ব্যবহার সম্পর্কে ঠাকুর বলেছিলেন, শ্রীমা নিজের গর্ভধারিণী মাকে দিতে পারে। তবে সাবধান করেছিলেন, তাঁকে মনুষ্য বুদ্ধিতে নয়, ভগবতী বুদ্ধিতে দিতে হবে। মানুষের মধ্যে ভগবত সত্তার আর�োপ নয়, সত্যি সত্যি ভগবান দেখে তার সেবা করতে হয়। স্বামীজীর নারায়ণজ্ঞানে নরের সেবার কথা মনে করিয়ে যায়। এই মানুষেই ভগবানের সত্তা বিরাজিত। ভগবান হয়ে ভগবানের পূজা করার কথা রয়েছে ‘দেবভূত্বা দেবং যজেত’। আমরা মানুষকে মানুষ না দেখে তার মধ্যে ভগবত সত্তা দেখার অভ্যাস করলে প্রতিটি মানুষই এই মরজগতকে অমৃতময় জগতে পরিণত হতে পারবে। তাহলে সকল দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে এখানেই স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতি অনুভব করতে পারবে।

০২৭

০২৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পনের�ো “মা—এই গ�োলাপ, য�োগীন, এরা কত ধ্যানজপ করেছে। এসব আল�োচনা করা ভাল। পরস্পরেরটা শুনে ওদেরও (ঢাকার ব�ৌ, নবাসনের ব�ৌ প্রভৃতি) এতে মতি হবে। দর্শনের কথা উঠলে, মা অনেক কথা চেপে গেলেন, সকলের সামনে সে সব বলবেন না বলে ব�োধ হয়। নলিনী—পিসীমা, ল�োকের কত ধ্যানজপ হয়, দর্শন-স্পর্শন হয় শুনি, আমার কিছু হয় না কেন? ত�োমার সঙ্গে এতদিন যে রইলুম, কই আমার কি হল�ো? মা—ওদের হবে না কেন? খুব হবে। ওদের কত ভক্তি বিশ্বাস! বিশ্বাস ভক্তি চাই, তবে হয়। ত�োদের কি তা আছে? নলিনী—আচ্ছা, পিসীমা, ল�োকে যে ত�োমাকে অন্তর্যামী বলে, সত্যিই কি তুমি অন্তর্যামী? আচ্ছা, আমার মনে কি আছে তুমি বলতে পার? মা একটু হাসলেন। নলিনী আবার শক্ত করে ধরলেন। তখন মা বললেন, “ওরা বলে ভক্তিতে।” তারপর বললেন, “আমি কি, মা? ঠাকুরই সব। ত�োমরা ঠাকুরের কাছে এই বল—(হাতজ�োড় করে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন) আমার ০২৯

‘আমিত্ব’ যেন না আসে।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৬৮) শ্রীভগবানের কথা আল�োচনায় সবার মঙ্গল হয়। গ�োলাপমা, য�োগীর-মা পরস্পরে জপধ্যান নিয়ে কথাবার্তা বলে থাকে। এস কথা নবাসনের বউ প্রমুখ শুনলে ওদের মঙ্গল হয়। ঝগড়া, পরস্পরের দ�োষ নিয়ে আল�োচনায় সময় অতিবাহিত করার চেয়ে ভগবৎপ্রসঙ্গ ভাল। শ্রীমায়ের কাছে নলিনীদিদি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, অনেকের দর্শনাদি হয়, তার কেন হয় না? শ্রীমাকে কত জনে কত ভাবে দর্শন করে থাকে। কেউ কালী ত�ো কেউ জগদ্ধাত্রী—তা নিয়ে নলিনীদিদির মনেও প্রশ্ন জাগে। সে জানে সবার কাছে শ্রীমা হলেও তার পিসি। এই আত্মীয়তাব�োধটুকু তার রয়েছে। আবারও তার জিজ্ঞাসা— ল�োকে শ্রীমাকে অন্তর্যামী বলে থাকে, তা নিয়েও জানার আগ্রহ প্রবল। শ্রীমা অতি সহজ ভাবে তার জবাব দিয়ে দেন, ভক্তিতে সব হয়৷ পরে আরও সহজ করে বলেন, ঠাকুরই সব৷ প্রার্থনা করতে আমিত্ব যেন না আসে৷ এই আমিত্ব থেকে আসে অহংকার৷ অহংকার থেকে ভগবানের বহুদূরে৷ এই দূরত্ব ঘ�োচাতে হলে আমিত্বের নাশ করা অত্যন্ত জরুরি৷ ০৩০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ষ�োল�ো “আমি—মা যে সাক্ষাৎ ভগবতী, একথা মা যদি নিজে দয়া করে বুঝিয়ে না দেন, তা হলে আমাদের সাধ্য কি বুঝি! তবে মায়ের ঈশ্বরত্ব এখানেই যে, মায়ের ভিতরে আদ�ৌ ‘অহঙ্কার’ নেই। জীবমাত্রই অহং-এ ভরা। এই যে হাজার হাজার ল�োক মায়ের পায়ের কাছে ‘তুমি লক্ষ্মী, তুমি জগদম্বা’ বলে লুটিয়ে পড়ছে, মানুষ হলে মা অহঙ্কারে ফেঁপে ফুলে উঠতেন। অত মান হজম করা কি মানুষের শক্তি! যাবার সময় হয়ে এসেছে। মা উঠে প্রসাদ হাতে দিয়ে বললেন, “প্রসাদে ও হরিতে ক�োন প্রভেদ নেই, (আমার বুকে হাত দিয়ে) মনে এটি স্থির বিশ্বাস রেখ�ো।” আজ বিশেষ করে কেন এটি বললেন? আজ তিন মাস হল�ো, প্রায় র�োজই আসি, যাই। যাবার সময় মা র�োজই হাতভরে প্রসাদ দেন। অনেককে দেওয়ার জন্য ক�োন ক�োন দিন প্রসাদের অভাব হতেও দেখেছি। মা তাই নিজের তক্তপ�োশের নিচে একটি সরায় করে প্রসাদ রেখে দিতেন এবং বলে রাখতেন, “ওরটি রেখে আর সবাইকে দিও গ�ো।”

—(৺সরযুবালা, পৃঃ ৬৯) জীবমাত্রই অহঙ্কারে পরিপূর্ণ; আর শ্রীমা অহংশূন্য। শ্রীমাকে মানুষ যেভাবে দেবতা জ্ঞানে সম্মান করে, সাধারণ মানুষ হলে তা কখন�োই হজম করতে পারত না। সম্মান দিলে মানুষ অহঙ্কারী হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য ক্ষেত্রে অয�োগ্য ব্যক্তিকে য�োগ্যতম পদে বসালে তার আচার-আচরণই পরিবর্তন হয়ে যায়। আর শ্রীমাকে কত সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি যথা ডাক্তার, হাকিম, বৈদ্য প্রমুখ ‘মা’ ‘মা’ বলে তাঁর পদতলে মাথা দিয়ে প্রণাম করেছে। কিন্তু তার ক�োন রকম পরিবর্তন লক্ষ্য হয় নি। মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে, যার যেখানে যখন দরকার, সেখানে কল্যাণ হস্তটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকে তাঁকে তাদের নিজের নিজের মা, ভগিনী প্রকৃতি রূপে পেয়েছে। সর্বোপরি তিনি যেমন জগতকে আপনার করে নিতে পেরেছিলেন, জগতবাসী তাঁকে ‘মাতৃ’ সম্বোধনে অবহিত করেছেন। মাতৃনামের মহিমা দিকে দিকে প্রচারিত হলেও, লেশমাত্র অহমিকা প্রকাশ পায়নি। পূর্ণ স্বাভাবিক থেকে সাধারণ হয়েও অসাধারণত্বের পরিচয় তিনি দিয়েছেন।

০৩১

০৩২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সতের�ো “মা এত দুর্বল যেন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হল�ো। নিচেই বসে আছি। ইত�োমধ্যে রাসবিহারী মহারাজ এসে মাকে বেশি কথা কইতে নিষেধ করে গেলেন। তবু মা মাঝে মাঝে দুচারটি কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে বসে আছি, এই সময় রাধারানী ছেলে ক�োলে করে এলেন, ছেলেটির অসুখ। আমি ছেলেটির হাতে কিছু দিয়ে দেখলুম। রাধু ত�ো কিছুতেই তা নেবে না। মা বললেন, “সে কি রাধু, দিদি আদর করে দিচ্ছে, আর তুই নিবি নে?” এই বলে নিজেই তুলে রাখলেন। ছেলেটি শুধু মা ও দিদিমার জন্যই নাইবার খাবার অনিয়মে অসুখে ভুগছে বলে কত আক্ষেপ করলেন। রাধু ত�ো ঢের কটূক্তি করে তার প্রতিবাদ করতে লাগল। “ওকে বলে ক�োন ফল নেই” বলে মা চুপ করে গেলেন। খানিক পরে সরলা, কৃষ্ণময়ীদিদি প্রভৃতি এলেন। মা শুয়েই তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।” —(৺সরযুবালা, পৃঃ ৭৬) শ্রীমা অসুস্থা হয়ে বিশ্রাম করছেন। সাধারণত এই সময়ে তাঁকে দর্শনে বাধা থাকে; অবশ্য দর্শন বন্ধ থাকলেও ক�োন

ক�োন ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী তঁার দর্শন পেয়েছে। তখন শ্রীমা শুয়ে শুয়ে কথা বলেন, আর ভক্ত চুপ করে তাঁর কথা শুনে যায়। সেবক রাজবিহারী মহারাজ মাঝ পথে বাধা দিলেও শ্রীমা বলতেন৷ ভক্তটি রাধুর ছেলেকে হাতে কিছু দিলে, রাধু নিতে চাইছে না দেখে শ্রীমা বলেছেন, ‘দিদি আদর করে দিচ্ছে, নে’। শ্রীমা ভক্তকে আপন ভাবেন, কিন্তু রাধু তা পারেনি। রাধুর ছেলেটি অসুস্থ, তার সঠিক আদরযত্ন না হওয়ায় েস অসুখে ভুগছে। শ্রীমা অসুস্থা হলেও তার সব দিকে সারাক্ষণ নজর থাকে। কে আসছে, কি করছে সবই তাঁর নজরে পড়ে। শুয়ে শুয়েই তিনি ভক্তদের মঙ্গল কামনাও করে চলেছেন। তাদের কল্যাণের জন্য অসংখ্য সংখ্যক জপও করেতন। গুরু হয়ে ভক্তদের ইহকাল ও পরকালের সকল দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই শত অসুবিধােতও জপধ্যান থেকে বিরত হন না। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যে, শরীর খারাপ থাকলেও জপধ্যানে ঈশ্বরচিন্তা বন্ধ করা যাবে না। মঙ্গল ও কল্যাণ িচন্তন করে যেতে হবে।

০৩৩

০৩৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আঠার�ো “আমি বলিলাম, “তবে ত�ো ভাল হবেই।” তখন মায়ের মুখে প্রফুল্লতা আসিল। ক্ষণপরেই মা বলিলেন, “দেখছ গা, কি ভক্তি! সবই আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর!” দেশে ফিরিবার দিনে মাকে প্রণাম করিতে গেলাম। আমি বলিলাম, “মা, আমি জপের সংখ্যা ঠিক রাখতে পারি না। হাত চলে ত�ো মুখ চলে না, হাত মুখ চলে ত�ো মন স্থির হয় না।” মা উত্তর করিলেন, “এর পর দেখবে, হাত, জিবও চলবে না—শুধু মনে।” আসিবার সময় প্রণাম করিয়া বলিলাম, ‘মা, যাই।’ মা শুনিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, ‘আসি’ বল, ‘যাই’ বলতে নেই।” —(শ্রীশচন্দ্র ঘটক, পৃঃ ৮০-৮১) শ্রীমা তার কথার উপর নির্ভর করে ভক্ত তার কাজ শুরু করে জেনে বড় খুশি হয়েছেন। তাঁকে নির্ভর করেছে, বিশ্বাস করেছে অর্থাৎ ভগবানের উপর নির্ভর বা িবশ্বাস এসেছে৷ বড় সুখের খবর। শ্রীমাকে ঠিকভাবে ধরে থাকতে পারলে আর কিসের কি প্রয়োজন। তিনি সবই ০৩৫

করে দেবেন—ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান; সবই দেখবেন। শরণাগত হয়ে তাঁর শ্রীচরণে পড়ে থাকলেই হলো৷ ভক্তের মনে উৎকণ্ঠা—জপ করতে গেলে যা যা সমস্যা হয় তা নিবেদন করেছে৷ সাধারণত যা হয়ে থাকে জপ করতে গেলে হাত চলে ত�ো মুখ চলে না, মুখ চলে ত�ো হাত চলে না। শ্রীমা কি সুন্দর করে বুিঝয়ে বলেছেন এরপর শুধু মন চলবে অর্থাৎ মনে মনে জপ চলতে থাকবে। জপের সংখ্যা রাখার অর্থ একটা নিয়মের গণ্ডি টেনে তাতে অভ্যাস করা। কায়মন�োবাক্যে সর্বদা ঈশ্বরে স্মরণ করতে পারলেই হল�ো। কেবলমাত্র ১০৮ বার জপ সকাল-সন্ধ্যায় করলেই কি হবে? নিয়ম রক্ষা করা হবে, কিছু না করার থেকে কিছু করা হল�ো এই মাত্র৷ কিন্তু ভগবানের নামে তন্ময়তা আসা দরকার। এর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় মানস জপ। সেটাই শ্রীমা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। আবার একটি সামাজিক প্রথার কথাও বলেছেন। বাইরে যাওয়ার সময় ‘যাই’ না বলে ‘আসি’ বলার অভ্যাস করা। এতে প্রিয়জনের িবদায়ের রুড়তা কমিেয় তা আশাব্যঞ্জক করে তোলে; যার ব্যবহািরক মূল্য অনেকখানি৷ ০৩৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনিশ “মা—হ্যাঁ, ঠাকুরকে অন্নভ�োগ দেবে। তিনি সুক্ত খেতে ভালবাসেন। আমি—ঠাকুরকে মাছভ�োগ দেব কি? মা—হ্যাঁ, তাঁকে মাছ দেবে। ঠাকুরের মন্ত্র উচ্চারণ করে তাঁকে নিবেদন করবে। মা জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলে মাছ খায় কি?” আমি—হ্যাঁ, খান। মা—খাবে বই কি, খুব খাবে। কথায় কথায় আমি বলেছিলাম, “মা, এই যুদ্ধে দেশব্যাপী হাহাকার, ল�োকের কত কষ্ট, অন্নবস্ত্র দুর্মূল্য।” মা—এতেও ত�ো ল�োকের চৈতন্য হয় না। আমি—মা, এই যুদ্ধে কি আমাদের ভাল হবে? মা—ঠাকুর যখনই আসেন, তখনই এরূপ হয়ে থাকে। আরও কত কি হবে।...” —(শ্রীশচন্দ্র ঘটক, পৃঃ ৮৩) ভক্তের মনোবাসনা—তাঁর ইষ্টসেবা নিজের মত�ো করে।

‘আত্মবৎ সেবা’র কথা ঠাকুরও বলেছেন। নিজে যা খেতে ভালবাসে, যা পরতে ভালবাসে—তা দিয়ে ইষ্টসেবা করার ভাবই ‘আত্মবৎ সেবা’। ঠাকুরকে মাছ ভ�োগ নিবেদন করার বাসনায় ভক্তের জিজ্ঞাসকে শ্রীমা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছেন এবং এও মনে করিয়েছেন যে, ঠাকুর সূক্ত খেতে ভালবাসতেন। ঠাকুরকে নিবেদিত অন্ন পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে হবে। ভক্তি ও শ্রদ্ধায় প্রদত্ত নৈবেদ্য ঠাকুর হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন। ঐ প্রসাদ গ্রহণে মনের মালিন্য দূর হয়। ভগবৎ প্রসাদে মন�োতুষ্টি ও আত্মতৃপ্তির হয় এবং চিত্তশুদ্ধি হয়ে ভগবৎ সমীপে যাওয়ার পথ সুগম করে দেন। এভাবেই ভগবৎ দর্শন ঘটে৷ মাছ ভ�োগ প্রসাদ গ্রহণে মাথা ঠাণ্ডা হয়। তখন ঐ মস্তকে শ্রীগুরুর ধ্যান গাঢ়তর হয়ে ওঠে। আধ্যাত্মিক জীবনযাপনে ইচ্ছুক সাধককে তার মন�োমত আহার না দিলে মানসিক অশান্তিতে কষ্ট পেতে হয়। তাই ঠাকুরকে পঞ্চব্যঞ্জনে ভ�োগ নিবেদন করে সেই প্রসাদ ধারণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে।

০৩৭

০৩৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

কুড়ি “একবার ঠাকুরকে ভ�োগ দিতে গিয়ে দেখি—ছবি হইতে একটা আল�োর স্রোত নৈবেদ্যের উপর পড়িয়াছে। তাই মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, যা দেখি সে কি মাথার ভুল, না সত্যি? যদি ভুল হয় তবে যাতে মাথা ঠাণ্ডা হয় তাই করে দাও।” মা একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “না বাবা, ও সব ঠিক।” আমি—তুমি কি জান, কি দেখি? মা—হ্যাঁ। আমি—ঠাকুরকে ও ত�োমাকে যে ভ�োগ দিই তা কি ঠাকুর পান? তুমি কি তা পাও? মা—হ্যাঁ। আমি—বুঝব কি করে? মা—কেন, গীতায় পড় নাই—ফল, পুষ্প, জল ভগবানকে ভক্তি করে যা দেওয়া যায়, তা তিনি পান। এ উত্তরে বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “তবে কি তুমি ভগবান?” এই কথায় মা হাসিয়া উঠিলেন। আমরাও ০৩৯

হাসিতে লাগিলাম।” —(শ্রীপ্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলি, পৃঃ ৮৫-৮৬) শুদ্ধ ভক্ত ভগবানকে ভ�োগ নিবেদন করে দেখছে, একটি আল�োক রশ্মি ভ�োগের উপর পড়েছে অর্থাৎ ভগবানকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিবেদিত নৈবেদ্য তিনি গ্রহণ করছেন। সূক্ষ্মাকারে তা গৃহীত হয়ে প্রসাদে পরিণত হয়। শুদ্ধসত্ত্ব সাধক এই ‘গ্রহণ’ দর্শনের সুয�োগ পায়। ভগবৎ প্রদত্ত প্রসাদে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এমনই একটি ঘটনায় শ্রীমাও তা গ্রহণ করেন কি না জানতে চাইলে, শ্রীমা তা স্বীকার করে নিয়েছেন। ভক্ত আবারও প্রশ্ন করে, কি করে ব�োঝা যাবে যে, ভগবান নিবেদিত নৈবেদ্য গ্রহণ করেছেন? শ্রীমা তখন সর্বশাস্ত্রের সার গীতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘পত্রং পুষ্পং ফলং ত�োয়ং...’ ভক্তিভাবে নিবেদন করলে তিনি তা গ্রহণ করেন। অকাট্য যুক্তি; খণ্ডনের প্রশ্ন উঠে না। প্রশ্ন ঃ ‘তবে কি তুমি ভগবান’? শ্রীমা ভগবতী ছাড়া কি? শরৎ মহারাজকেও এমন প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেছিলেন, ঠাকুর কি ঘুঁটে কুড়ুনীকে বিয়ে করেছিলেন? অবশ্যই তিনি ভগবতী। এইভাবে সকল সংশয় নিরসন করে দিয়েছিলেন৷ ০৪০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একুশ “আর একবার ক�োয়ালপাড়া মঠে শ্রীশ্রীমায়ের সহিত কথাপ্রসঙ্গে মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, সাধন-ভজন কিছু হয়ে উঠছে না।” মা অভয় ও আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “ত�োমাকে কিছু করতে হবে না, যা করতে হয় আমি করব।” বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “আমার কিছু করতে হবে না?” মা—না। আমি—তবে এখন হতে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতি আমার নিজ কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে না? মা—না, তুমি কি করবে? যা করতে হয় আমি করব। শ্রীশ্রীমায়ের এই অহেতুক কৃপায় আমি নির্বাক হইলাম। পুনরায় কথাপ্রসঙ্গে মায়ের পায়ের ব্যথার কথা উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনেছি কেউ কেউ পা ছুঁলে ত�োমার কষ্ট হয়, মা?” মা—হ্যাঁ বাবা, কেউ কেউ ছুঁলে শরীরটি যেন শীতল হয়ে যায়। আবার এক একজন আছে ছুঁলে মনে হয় যেন ব�োলতায় কামড়ে দিলে। কাউকে কিছু বলিনে।” ০৪১

—(শ্রীইন্দুভূষণ েসনগুপ্ত, পৃঃ ৮৮) অদ্যাপি করেন লীলা গ�োরা রায়, ক�োন ক�োন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়। আজও েসই লীলা অব্যাহত। কিন্তু সবার তা দেখার সুয�োগ হয় না, ভাগ্যবানেরই কপালে তা জোটে। েকায়ালপাড়ায় শ্রীমাকে একান্তে ভক্ত তার করণীয় সাধনভজন প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন, তাকে কিছু করতে হবে না। তিনি অর্থাৎ শ্রীমা-ই তার জন্য সব করবেন। ভাগ্যবান না হলে কি, এমন আশ্বাস কেউ পায়? তাই বুঝি বা শ্রীমা লক্ষাধিক জপ করেন; কত জানা ও অজানা ভক্তের নামে তাঁর শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলী নেন। আবার বলেছেনও, ক�োন ক�োন ভক্তের প্রণামে তাঁর প্রাণ জুড়িয়ে যায়, আবার কারও প্রণামে বা ব�োলতা কামড়ান�োর মত জ্বালা অনুভব করেন। কে কোন সাধন স্তরে রয়েছে আমরা কেউ জানি না। তবে তাঁর শরণাগত হলে তিনি তার সব দায়িত্ব নেন—এই যা আশার কথা। ভগবানে হৃদয় সঁপে করে বসে থাকতে হয়৷ তাঁর হাতের যন্ত্র স্বরূপ হয়ে জীবনযাপন করাতে যেন ক�োন�ো ত্রুটি বা কার্পণ্য না থাকে। আর মনমুখ এক করে শ্রীমায়ের আশ্রয় নিতে হয় এবং কর্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে আমােদর নিরন্তর প্রার্থনা হবে৷ ০৪২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বাইশ “আমি বলিলাম, “না, আমার কাছে টাকা আছে।” এই বলিয়া রঘুবীরকে প্রণাম করিয়া আসিলাম। বিদায় লইবার জন্য মাকে প্রণাম করিয়া উঠিতেছি, এমন সময় মা সহসা বলিয়া উঠিলেন, “বৈকুণ্ঠ, আমায় ডাকিস্।” এই কথার পরমুহূর্তেই আবার বলিলেন, “ঠাকুরকে ডেক�ো, ঠাকুরকে ডাকলেই সব হবে।” এই সময় লক্ষ্মীদিদি সেখানে ছিলেন, তিনি বলিয়া উঠিলেন, “না, মা, একি কথা? এ-ত�ো বড় অন্যায়! ছেলেদের এমন করে ভুলালে তারা কি করবে!” মা বলিলেন, “কই, আমি কি করলুম?” লক্ষ্মীদিদি—মা, তুমি এই মুহূর্তে বৈকুণ্ঠকে বললে, ‘আমায় ডাকিস্’, আবার বলছ, ‘ঠাকুরকে ডেক�ো।’ মা বলিলেন, “ঠাকুরকে ডাকলেই ত�ো সব হল�ো।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ৯২) শ্রীমা নিজের অজান্তেই তাঁর দৈবীসত্তার পরিচয় দিয়ে ফেলেছেন। রঘুবীরকে প্রণাম করে শ্রীমাকে প্রণাম করতেই বৈকুণ্ঠ শুনেছে, শ্রীমা বলছেন, ‘বৈকুণ্ঠ, আমায় ডাকিস’৷ অন্তিমে ঈশ্বর স্মরণ করে দেহত্যাগ করতে

হবে—এ যেন তারই অনুকল্প। শ্রীমা বৈকুণ্ঠকে তাঁকে স্মরণ করতে বলার অর্থ—ঠাকুর ও শ্রীমা অভেদ, টাকার এপিট ওপিট। এই নিয়ে শ্রীমা নানান সময় নানান জনের সঙ্গে বাদানুবাদের কপট মান অভিমানের মাধ্যমে লীলাখেলা খেলা খেলেছেন। এখানেও শ্রীমা ‘আমায় ডাকিস’ বলে, আবার ঠাকুরকেও ডাকতে বলেছেন। সাক্ষীস্বরূপ লক্ষ্মীদিদি এ কথা অবতারণা করলে বলেছেন, মা, এমন করে ভুলালে চলবে না। ছেলেরা সব বুঝতে পারে৷ তাতেও শ্রীমা ছাড়বার পাত্রী নন, বলেছেন, ঠাকুরকে ডাকলেই হবে। ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও ব্যাপারটি একই তা হলো স্মরণ করা৷ যার যেমন রুচি ও ভালবাসা; কারও ঠাকুরের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক লাগে, আবার কারও বা শ্রীমায়ের কাছে। যে যেভাবে যাকেই ডাকুক না কেন, অন্তিমে যেন ডাকতে ভুল না হয়, তাই অভ্যাস করা খুবই দরকার৷ নতুবা বৃথা হয়ে যাবে এই জন্ম মরণচক্র থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা। তখন জীবনচক্রে বারবাের গতায়ত করতেই হবে৷

০৪৩

০৪৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তেইশ “আর একদিন আমরা কয়েকজন মিলিয়া ৺বাসন্তীপূজার সময় জয়রামবাটী গিয়াছিলাম। রাস্তায় সাদা পদ্মফুল দেখিতে পাইয়া কিছু সংগ্রহ করিয়া লইয়াছিলাম। যখন আমরা ঐ ফুল শ্রীশ্রীমায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দিব বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিলাম, সেই সময় মা বলিয়া পাঠাইলেন, “দেবীর পূজাতে সাদা ফুল লাগে না।” এ সংবাদ পাইয়া আমরা পুনরায় লালপদ্ম সংগহ করিয়া তাঁহার পাদপদ্মে অঞ্জলি দিয়াছিলাম। একদিন তাঁহার সাংসারিক ক�োন কথায় শুনিলাম—মা যেন কাহাকে বলিতেছেন, “আমাকে বেশি জ্বালাবে না, কারণ আমি যদি চটেমটে কাউকে কিছু বলে ফেলি ত�ো কার�ো সাধ্য নেই যে আর রক্ষা করে।” সেবার মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, আজকাল সরকার যে ছেলেদের ধরে ধরে আটক করে রাখছে, এর পরিণাম কি হবে?” তদুত্তরে মা বলিয়াছিলেন, “তাই ত�ো বড় অন্যায়। এর একটা প্রতিকার শীঘ্র হবে। আর বেশি দিন নয়—ভাল হবে।” —(স্বামী অরূপানন্দ,পৃঃ ৯৪) ঘটনাচক্রে শ্রীমায়ের দৈবীসত্তার বহির্প্রকাশ কখন�ো কখন�ো

ঘটেছে। যেমন তঁার চরণে পুষ্পাঞ্জলি দানে ভক্তের ইচ্ছায় ক�োন রঙের ফুলে দেবী পূজা বিধেয় তা জানিয়ে বলেছেন দেবী পূজাতে শ্বেতপদ্ম নয়, লালপদ্ম দরকার হয়। যে মন্ত্রউপচারে যে দেবতা তুষ্ট হন, তাই করা উচিত। বিধি মানা পূজাতে তুষ্ট হন দেবতা; তাতে পূজকও শান্তি লাভ করে। শ্রীমায়ের মধ্যে মহামায়ীর দশমহাবিদ্যার একরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে যখন বলে ফেলেন, তাঁকে রাগালে কেউ রক্ষা পাবে না—ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও েস ক্ষমতা নেই। একবার ঠাকুরও হৃদয়রামকে সাবধান করে একথা বলেছিলেন। আর এখানে শ্রীমা নিজের মুখেই তা প্রকাশ করলেন। এই সময় কথাপ্রসঙ্গে তাঁকে বলা হয়—সরকার যে ছেলেদের ধরে আটক করে রাখছে, তার পরিণাম কি হবে? শ্রীমা তার উত্তরে জানিয়েছেন, এর প্রতিকার শীঘ্রই হবে। আর বেশিদিন নয়। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী ফলপ্রসু হওয়া ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। যথাসময়ে তার সুপ্রতিকার হয়েছে। শ্রীমায়ের বগলামূর্তিতে হরিষকে প্রহার করার কথা মনে পড়ে। প্রয়োজন ছিল তাই সেই ভীষণাকার মূর্তি ধরতেও ক�োন বাধা আসে নি। এভাবেই তঁার দৈবীসত্তার পূৃর্ণ প্রভা প্রকাশিত হয়েছে নানান সময়ে, নানান ভাবে।

০৪৫

০৪৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চব্বিশ “এই কথা শুনিয়া মা খুব জ�োরের সহিত বলিলেন, “কি, আমার ছেলে হয়ে তুমি রসাতলে যাবে? এখানে যে এসেছে, যারা আমার ছেলে, তাদের মুক্তি হয়ে আছে। বিধির সাধ্য নাই যে আমার ছেলেদের রসাতলে ফেলে।” আমি—তবে, মা, এখন কি করব? মা—আমার উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাক। আর এটা সর্বদা স্মরণ রেখ যে, ত�োমাদের পেছনে এমন একজন রয়েছেন যিনি সময় আসলে ত�োমাদের সেই নিত্যধামে নিয়ে যাবেন। আমি—মা, যতক্ষণ আপনার নিকট থাকি, খুব ভাল থাকি। সংসারের ক�োন চিন্তা আমার থাকে না। আর যেমন বাড়ি যাই, অমনি মনে নানা কুচিন্তা আসে। আবার সেই পুরন�ো অসৎ সঙ্গীদের সঙ্গে মিশি, আর অন্যায় কাজ করি। যত চেষ্টা করি, কিছুতেই কুচিন্তা দূর করতে পারি না।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ৯৬) শ্রীমা অভয় দিচ্ছেন তাঁর ছেলে হয়ে কখন�োই কেউ রসাতলে যেতে পারে না। ভক্ত তার মনের কথা ব্যক্ত

০৪৭

করেছেন, যতক্ষণ সে মায়ের কাছে থাকে, ততক্ষণ তার মন ভাল থাকে; সৎ ভাবে থাকে। কিন্তু গৃহে ফিরে অসৎ সঙ্গ পরিহার করতে পারে না তাই মনে ক্ষোভ জন্মেছে। শ্রীমা জানাচ্ছেন, ও সব পূর্ব জন্মের প্রারব্ধ কর্মফল। যারা একবার ঠাকুরের আশ্রয় নিয়েছে শ্রীমা স্বয়ং তাদের দায়িত্ব নেন; তাই কারও সাধ্য নেই তাদের ক্ষতি করে। সর্বদা তাঁদের ঈশ্বর স্মরণে মননে দিন কাটাতে পারলেই হল�ো। জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার তাঁদের কৃপায় ক্রমে ক্রমে কেটে যাবে এবং অন্তিমে মুক্ত হবে। তাঁদের আশ্রিতদের প্রতি এ হেন আশ্বাসবাণী বারবার ব্যক্ত হয়েছে। তিনি সৎসঙ্গে থাকার এবং ঠাকুরকে ডাকার নিদান দিয়েছেন। নিশ্চিত করেই যখন ভরসা দিচ্ছেন, তখন মুক্তি হবেই হবে। তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ভক্তকে পরম আনন্দে দিন গুজরান করার জন্য বলেছেন। তাই শ্রীমায়ের বাড়িতে ছেলেরা নিশ্চিন্তে আনন্দ করে খায় আর ঘুমায়। কিন্তু ঐ বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন সহজ নয়। তাই ভাবনা আসে সত্যি হবে ত�ো? এই সন্দেহ থেকেই আসে ভয় এবং নির্ভরতাতে ব্যাঘাত সৃষ্ট হয়। তাই এরকম ভরসা পেয়েও শান্ত হতে না পারলে শ্রীমায়ের সামনেই বসে চ�োখ বন্ধ করে প্রাণায়ামাদি করে তঁাতে শান্ত সমাহিত হতে হবে।

০৪৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁচিশ “পরে শ্রীপাদপদ্ম পূজা করিলাম। মা দাঁড়াইয়া পূজা গ্রহণ করিলেন। আমি বলিলাম, “মা, আমি ত�ো মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি না।” মা বলিলেন, “অমনিই দাও না।” আমি ‘জয় মা’ বলিয়া পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিলাম। একটি ধুতরা ফুল ছিল— মা বলিলেন, “ওটি দিও না—ও শিবের পূজায় লাগে।” মায়ের জন্য কাপড় লইয়া গিয়াছিলাম, সেই কাপড়খানি আর একটি টাকাও দিলাম। টাকা দেওয়াতে মা বলিলেন, “ত�োমার টানাটানি অভাব—আবার টাকা কেন?” সাংসারিক অভাব সম্বন্ধে ত�ো ক�োন কথাই হয় নাই, অথচ দেখিলাম মা সবই জানেন! আমি বলিলাম, “এ-ত�ো ত�োমারই টাকা, ত�োমাকেই দেওয়া হচ্ছে; আমাদের পরিশ্রমে যা কিছু আসে, তার সামান্যও যদি ত�োমার সেবায় লাগে, আমরা ধন্য মনে করি।” মা বলিলেন, “আহা! কি টান গ�ো, কি টান!” —(শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ৯৮) আশ্রিত সন্তানের প্রতি শ্রীমায়ের ব্যবহারের একটি অপূর্ব চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে। মন্ত্র তন্ত্রের বালাই নেই, কি মন্ত্রে দেবতার চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয়, তা জানা না থাকলেও ০৪৯

অসুবিধা হলো না। সন্তান ‘জয় মা’ বলে অঞ্জলি প্রদান করেছে। ভক্ত হৃদয়ের টানে অর্থ দিয়ে প্রণামী দিলে, শ্রীমা তার অভাবের সংসারের কথা তুলে তা দিতে বারণ করলেও েস শ�োনে না। বলে ‘ত�োমারই টাকা, ত�োমায় দিচ্ছি’। কি বিশ্বাস! ভগবানের অর্থ ভগবানকে দিচ্ছে; এমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ধারণা পরিষ্কার আছে—সবই ভগবানের সৃষ্ট জিনিস আবার তাই তাঁকেই দিচ্ছে। এ যেন গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা। ভক্তের সাংসারিক কষ্ট থাকলেও তাতে যে সে ডুবে যায়নি বা আরও ‘দাও, দাও’ বলে অর্থাদি প্রার্থনা করেনি; তাতেই তার সাংসারিক বন্ধন যে অনেকটা শিথিল হয়েছে ব�োঝা যায়। যে সত্য সত্যই ভগবানকে চায় তার প্রার্থনাতে কখন�োই পার্থিব চাহিদার প্রকাশ থাকে না। ভগবানকে নিয়ে জীবন কাটাতে চাইলে, ম�োটা ভাত কাপড়ের সব ব্যবস্থা ভগবানই করে দেন। শ্রীমায়ের কথা, ‘সবই ত�ো দুট�ো দুট�ো’ বলে সংসার-সমুদ্রে ছেড়েও দেন। যার যেমন ইচ্ছা, তেমনটাই ঘটিয়ে যথাসময়ে তার প্রার্থিত বিশেষ ফলটি প্রদান করেন, কাউকে নিরাশ করেন না। ০৫০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছাব্বিশ “ত�োমার এমনিই সব হবে। গেরুয়ার দরকার কি?” শ্রীশ্রীমায়ের জন্য একজ�োড়া কাপড় লইয়া গিয়াছিলাম। মাকে বলিলাম, “মা, শুনেছি তুমি কাপড় সকলকে বিলিয়ে দাও। তুমি যদি নিজে কাপড় দুখানি পর, তবে আমার খুব আনন্দ হয়।” শুনিয়া মা কিছু বলিলেন না— একটু হাসিলেন। পরদিন আমি যাইতেই বলিলেন, “এই দেখ, বাবা, তুমি যে কাপড় এনেছ তা পরেছি।” আমার প্রার্থনায় শ্রীশ্রীমা আমাকে তাঁহার ব্যবহৃত একখানি কাপড় দিয়া বলিয়াছিলেন, “বড় ময়লা, তুমি ধুইয়ে নিও।” আমি বলিলাম, “না, মা তুমি যেমনটি দিয়েছ, ঠিক তেমনি রাখতে ইচ্ছা, ধ�োপার ঘরে দেওয়া হবে না।” মা—আচ্ছা, সেই ভাল।” —(শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০২) সন্ন্যাসের অধিকারী না হলে শ্রীমা তাদের কথার ক�ৌশলে সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতেন। আসলে কার ভিতরে কি শক্তি আছে তা তিনি ০৫১

পরিষ্কার দেখতে পান বলেই এরকম করে থাকেন। ভক্তসন্তানের বাসনা হয়েছে তার দেওয়া কাপড় দুখানি শ্রীমা পরেন। সশ্রদ্ধ ভালবাসায় দেওয়া উপহারের মান রাখতে হয়। তাই পরের দিনই ঐ কাপড় পরে শ্রীমা তাকে দেখিয়েছেন। পরে একখানি প্রসাদী কাপড় দিয়ে বলেছেন, এখানি বড় ময়লা, কাচিয়ে নিও। ভক্ত সন্তান সভক্তিতে বলে ওঠেন, ‘না মা, যেমনটি দিয়েছেন, তেমনটি থাকবে, এটি ধ�োপার বাড়িতে যাবে না’। শ্রদ্ধায় ভালবাসায় ভগবত প্রদত্ত বস্তুর সমাদর করাতেও অন্তরের ভাবটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। অন্তরে যে স�োনা চাপা রয়েছে তা বেশ ব�োঝা যায়, ছ�োট ছ�োট কথার মাধ্যমে৷ ভিতরে শ্রদ্ধা না থাকলে কখন�োই এভাবে মুখ দিয়ে এমন কথা বের হত�ো না। মানুষের ব্যবহারই মানুষের পরিচয়। ঠাকুরের কথা—মূল�ো খেলে মূল�োর ঢেকুর ওঠে, অন্তরে ভগবৎ প্রসঙ্গের গভীরতা না থাকলে ঈশ্বরীয় বাক্য বের হবে না। টিয়াকে শেখান�ো বুলি ‘রাধা কৃষ্ণ নাম’ বিড়ালে ধরলে বলে না। ০৫২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতাশ “আমার স্ত্রী কপালে সিঁদরু ছিল না; স্ত্রী-ভক্তদের মধ্যে কে একজন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “হ্যাঁ গা, ত�োমার কপালে সিঁদরু নেই কেন?” ঐ কথা শুনিয়া মা বলিয়াছিলেন, “তা আর কি হয়েছে? ওর এমন স্বামী সঙ্গে, নাই বা পরেছে।” এই বলিয়া মা স্বয়ং তাহার কপালে সিঁদরু পরাইয়া দিলেন। আমার স্ত্রী মনে হইয়াছিল—‘মা যদি অনুমতি করেন তবে পদসেবা করি।’ মা কিছুক্ষণ পরে তাহাকে বলিলেন, “এস, ব�ৌমা, আমার গায়ে মাথায় তেল মাখিয়ে দাও।” তেল মাখাইয়া চিরুনি দিয়া চুল আঁচড়াইয়া দিতে দিতে তাহার ইচ্ছা হইয়াছিল, ‘যদি এই চুল কিছু নিতে অনুমতি দেন ত�ো নিই।’ মা ঈষৎ হাসিয়া নিজেই বলিলেন, “এই নাও, মা।” তারপর চিরুনির গাত্রসংলগ্ন চুল ছাড়াইয়া তাহার হাতে দিলেন।” —(শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০৪-১০৫) শ্রীমা সাংসার জীবনেও ছিলেন অতুলনীয়া। ভক্তদের মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন তুলকালাম কাণ্ড ঘটে থাকে তখন শ্রীমা সহজে তা দূরীকরণেও সিদ্ধহস্ত। এইরূপ এক ঘটনা—একজন এয়োস্ত্রীর মাথায় সিঁদরু নেই দেখে, অন্যেরা তা নিয়ে নানান কটুকাটব্য রটনা করতে পারে এবং করতে ০৫৩

উদ্যত দেখে শ্রীমা বলেছেন, তাতে কি হয়েছে, যার এমন স্বামী সঙ্গে, তার সিঁদরু নাই বা থাকল মাথায়—বলতে বলতে নিজেই তার মাথায় সিঁদরু পরিয়ে দিলেন। শ্রীমা, যা নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি হতে পারত, তা নিমিষে অতি সহজ ভাবে সমস্যা জটিল হওয়ার পূর্বেই সমাধান করে দিলেন। সেই মহিলা ভক্তের আবার শ্রীমায়ের সামান্য একটু সেবা করার ইচ্ছা হয়েছে বুঝতে পেরে তিনি তা তৎক্ষণাৎ পূর্ণ করে দিয়েছেন। শ্রীমায়ের মাথার পবিত্র চুল নেওয়ার ইচ্ছাও পুিরয়ে দিয়েছেন। ঈশ্বর কৃপা করলে পরিস্থিতি সবই অনুকল ূ হয়ে যায়। মনের মলিনতা দূর করে পবিত্র করে তোলেন; বুঝতেই পারা যায় না কিভাবে অসাধ্যকে সাধন করে ম�োক্ষদ্বারে পৌঁছে দেন। অন্তর শুদ্ধ পবিত্র হলে ভগবান তা পবিত্রতম করে ত�োলেন। একটু কিছু প্রারন্থ া করলে অনেক বেশি প্রদান করেন। ভগবানের স্বভাব সমস্ত দিয়ে ফকির হওয়া৷ ঈশ্বরের সামান্য কৃপায় মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রারন্থ ায় ‘দাও, দাও’ করে চাওয়ার অপেক্ষা রাখে না—অহেতুক কৃপায় তার দুহাত ভরে ওঠে।

০৫৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটাশ “মা বলিলেন, “শ�োকে তার কিছু করতে পারবে না।” মায়ের কথা শুনিয়া ফিরিবার পথে ক�োয়ালপাড়ায় আমি তাঁহাকে দর্শন করিতে গিয়া দেখিলাম—তাঁহার শ�োকের নামগন্ধও নাই, সেই সদা হাস্যমখু ! ভাবিলাম—‘স্বয়ং বশিষ্ঠ ঋষির শ�োক হয়েছিল, এ ঘরের যেন সবই নতুন!’ ‘উদ্বোধনে’র বাটীতে একবার শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্র মুখ�োপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাই। মাকে প্রণাম করিবার পর মা করজ�োড়ে ঠাকুরের কাছে প্রারন্থ া করিলেন, “ঠাকুর, এদের সকল বাসনা পূর্ণ কর।” আমি বলিলাম, “সে কি, মা, সকল বাসনা পূর্ণ করলে ত�ো উপায় নেই! মনে যে কত কু-বাসনা রয়েছে!” মা হাসিয়া বলিলেন, “ত�োমাদের সে ভয় নেই। ত�োমাদের যা দরকার, যাতে ভাল হয়, ঠাকুর তাই দেবেন। ত�োমরা যা করছ করে যাও। ভয় কি? আমরা ত�ো রয়েছি।” —(শ্রীসুরেন্দ্র সরকার, পৃঃ ১০৮) ঈশ্বরানন্দে ভরপুর প্রাণে পার্থিব শোক কোন রেখাপাত করে না জানিয়ে শ্রীমায়ের অভয় ও আশ্বাস বাণী—‘যা

করছ, করে যাও আমরা ত�ো আছি।’ ভক্তের সব বাসনা পূর্ণ করার আর্জি জানিয়ে শ্রীমা ঠাকুরের কাছে প্রারন্থ া করলে, ভক্ত সন্তান শ্রীমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, মনের অন্য কুবাসনাও কি পূর্ণ করে দেবেন? আসলে আমরা বাসনাও ঠিক করে করতে পারি না। ক�োন বাসনায় আমাদের মঙ্গল, আর ক�োন বাসনায় অকল্যাণ হয় তাও ঠিক জানি না৷ কথার জবাবে শ্রীমা বলেন, ত�োমাদের ভয় নেই, ঠাকুর যাতে শুধুমাত্র ভাল হয়, তাই করবেন। আর ঠাকুর-মাকে ধরে থাকলে বেচালে পা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই নাচতে জানতে হয় অর্থাৎ সৎভাবে জীবন যাপন করা দরকার। জাত সাপে ধরার মত�ো ঠাকুর যাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের বিপদ স্পর্শ করতে পারে না৷ তিনি যে বিপদের রাস্তা পরিষ্কার করে রাখেন, ভক্তকে রক্ষার দায়িত্ব যে ভগবানেরই। ভগবান সর্বদাই যা করেন সবই ভক্তের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর৷ তার উন্নত আধ্যাত্মিক জীবন যাতে নিষ্কণ্টক হয় তাও দেখেন। ভগবানের কাছে মাথা নত করলে ভক্তের ক�োন দুশ্চিন্তা হয় না। তখন েস কেবল আনন্দ, সদানন্দ আর পরমানন্দে সময় অতিবাহিত করবে৷

০৫৫

০৫৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনত্রিশ “আমি—কি জানি, মা, সংসার আমার ভাল লাগে না। প্রাণ যেন সংসার চায় না, প্রাণে বড়ই অশান্তি ছিল, আজ আমি শান্তি লাভ করেছি। আর এ সংসারও অনিত্য, দুদিনের জন্য, দেখছি সবই মিথ্যা। কি করে তাতেই বা মন বসবে, মা? এই সময়ে মায়ের সমবয়স্কা একটি স্ত্রীল�োক আসিয়া তাঁহার নিকট বসিলেন। আমি মায়ের খুব কাছে বসিয়াছিলাম, তাঁহার ছায়া আমার গায়ে পড়িয়াছে দেখিয়া উক্ত স্ত্রীল�োকটি আমায় ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি কেমন মেয়ে গা, মায়ের ছায়ার উপর বসেছ? পাপ হবে যে, সরে বস।” আমি ইহা জানিতাম না। মা যে আপন হইতেও আপনার, তাই একেবারে কাছে বসিয়াছিলাম, এখন একটু অপ্রতিভ হইয়া সরিয়া বসিলাম। উক্ত স্ত্রীল�োকটি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ মেয়েটি কে?” মা—এ মেয়েটি আজ দীক্ষা নিয়েছে, বড় ভক্তিমতী মেয়ে। মা বলিলেন, “আবার কবে আসবে, মা?” আমি—আপনি যেদিন মনে করে আনবেন সেই দিনই আসব; আমার ক�োন সাধ্য নেই। মা, আশীর্বাদ করুন; আমায় মনে রাখবেন মা।

মা—আবার এস, মা।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১১৪-১১৫) বহু জন্মের তপস্যার ফলে সংসারের অনিত্যতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হয়। শ্রীমায়ের কাছে দীক্ষা নিতে এসে এক ভক্তিমতী মহিলার এই জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ছিল, এই সংসার তার ভাল লাগে না; প্রাণে বড়ই কষ্ট ছিল। শ্রীমায়ের কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়ে েস পরম পরিতৃপ্ত। সংসারের বিশেষ আদব-কায়দা না জানা থাকায় শ্রীমাকে সে আপনজন ভেবেই তাঁর কাছাকাছি বসেছে। এদিকে শ্রীমায়ের কাছে নিত্য অবস্থানরতা একজনের ধমকে জানতে পাের যে, শ্রীমায়ের ছায়া তার গায়ের উপর িগয়ে পড়েছে যা বিধি বিরুদ্ধ৷ ব�োধবুদ্ধির অভাব নয়, অত্যধিক সরলতার জন্য শ্রীমাকে আপন ভেবে সে এমন ব্যবহার করে ফেলেছে। পরে শ্রীমা তাকে আবার কবে আসবে জানতে চাওয়ায় বলেছে, আপনি কৃপা করে যখন আনবেন, তখনই আসা হবে। এতে ভক্তির আতিশয্য নয়, অন্তরের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে। শ্রীমায়ের সান্নিধ্যে ভক্তের হৃদপদ্ম প্রস্টফু িত হয়েছে। তাই পরশমণির স্পর্শে ভক্ত হয়ে ওঠে ভক্তিমান।

০৫৭

০৫৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ত্রিশ “মা—(দৃঢ়তার সহিত বলিলেন) কি! ত�োমরা নিরাশ্রয় হবে কেন? ঠাকুর কি ত�োমাদের ভালমন্দ দেখছেন না? অত ভাব�ো কেন? ত�োমাদের যে তাঁর পায়ে সঁপে দিয়েছি। একটা গণ্ডির মধ্যে ত�োমাদের ঘুরতে হবেই, অন্য ক�োথাও যাবার জ�ো নেই। তিনি সর্বদা ত�োমাদের রক্ষা করছেন। আমি—ঠাকুরের দয়ার কথা অনেক সময় মনে হলেও সব সময় ঠিক বুঝতে পারি না। অনেক সময় বিশ্বাস হয়, অনেক সময় সন্দেহও আসে। আপনাকে সাক্ষাৎ দেখছি, ভাল মন্দ অনেক কথা বলেছি, আপনিও তার ভাল মন্দ বিচার করে কখন কিভাবে চললে আমার ভাল হবে, বলে দিয়েছেন। এতে আপনার কাছে আশ্রয় পেয়েছি, এটা বিশ্বাস হয়। মা বলিলেন, “ঠাকুর একমাত্র রক্ষাকর্তা—এটি সর্বদা মনে রাখবে। এটি ভুললে সব ভুল!” —(ব্রহ্মচারী অশোককৃষ্ণ, পৃঃ ১১৬) িতনটি বিষয়—ভক্ত, শ্রীমা ও ঠাকুর৷ এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান৷ ভক্ত শ্রীমায়ের িশষ্য৷ শ্রীমােক চাক্ষুষ দর্শন

করেছেন৷ ভাল মন্দ সব সামনা সামনি জেনেছেন ও বলেছেন৷ শ্রীমা, তঁার আদর্শ ঠাকুর৷ আবার ঠাকুর হলেন মঙ্গলময়৷ তাই ঠাকুরকে ধরে থাকার জন্য শ্রীমা সবর্দা নির্দেশ দিয়ে থাকেন৷ ভক্ত শ্রীমাকে সর্বজ্ঞ জ্ঞানে মান্যতা প্রদান করে৷ কিন্তু শ্রীমােয়র সব কিছুই তো ঠাকুর৷ শ্রীমায়ের অবর্তমানে নিরাশ্রয়ের ভাবনায় ভক্ত দ্বন্দ্বে পড়ে যায়৷ নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করলে শ্রীমা দৃঢ়তার সঙ্গে তার প্রতিবাদ করেন৷ ভক্তের ভালমন্দের সব ভার যে তিনি নিয়েছেন৷ তাই সবাইকে ঠাকুরের পায়ে সঁপে দিয়েছেন৷ ঠাকুর সবই রক্ষা করবেন৷ এতেও ভক্ত সন্দেহ প্রকাশ করেছে অবলীলাক্রমে৷ ঠাকুরের দয়া অনেক সময় অনুভব করতে পারে না, কখনো বা ঠাকুরের কথায় অবিশ্বাসও চলে আসে৷ তখন কি হবে? শ্রীমায়ের সহজ উত্তর, ‘ঠাকুর একমাত্র রক্ষাকর্তা—এটি সর্বদা মনে রাখবে। এটি ভুললে সব ভুল!’ অপূর্ব সুন্দর বাক্যটি সদা সর্বদা মনে রেখে চলতে পারলে েকান বিপদের আঁচ এসে স্পর্শও করতে পারে না৷ শ্রীমায়ের ‘আশ্রয়’ আর ঠাকুরের ‘প্রশ্রয়’—আর কি প্রাপ্তির প্রয়োজন ভক্তের!

০৫৯

০৬০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একত্রিশ “মা—ত�োমরা কি মনে কর, যদি ঠাকুর এ শরীরটা না রাখেন, তা হলেও যাদের ভার নিয়েছি তাদের একজনও বাকি থাকতে আমার ছুটি আছে? তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। তাদের ভাল-মন্দের ভার যে নিতে হয়েছে। মন্ত্র দেওয়া কি চারটিখানি কথা! কত ব�োঝা ঘাড়ে তুলে নিতে হয়! তাদের জন্যে কত চিন্তা করতে হয়! এই দেখ না, ত�োমার বাপ মারা গেলেন, আমারও মনটা খারাপ হল�ো। মনে হল�ো—ছেলেটাকে ঠাকুর কি আবার এক পরীক্ষায় ফেললেন! কিসে ঠেলেঠুলে বেঁচে উঠবে—এই চিন্তা। সেইজন্যই ত�ো এত কথা বললুম। ত�োমরা কি সব বুঝতে পার? যদি ত�োমরা সব বুঝতে পারতে, আমার চিন্তার ভার অনেক কমে যেত। ঠাকুর নানান ভাবে নানা জনকে খেলাচ্ছেন—টাল সামলাতে হয় আমাকে। যাদের নিজের বলে নিয়েছি, তাদের ত�ো আর ফেলতে পারিনে।” —(ব্রহ্মচারী অশোককৃষ্ণ, পৃঃ ১১৭) দীক্ষা দেওয়া কি সহজ কথা! িশষ্যের সব দায়দায়িত্ব নিতে হয়৷ ভাল, মন্দ, ইহকাল, পরকাল সব রক্ষার দায়ভার গুরুরূপী শ্রীমায়ের৷এমনকি শিষ্যের সংসারের কার কিছু অসুবিধা হলেও শ্রীমাকে দেখতে হয়৷ শ্রীমা যাদের ভার নিয়েছেন—তাদের ০৬১

সুখে-দুঃখে শেষ পর্যন্ত পাশে থাকতে হবে৷ অবশ্য নিজের দায়িত্ব কেউ নিজে নিতে পারলে শ্রীমায়েরও ভার লাঘব হয়৷ ঠাকুর নানান বিপদের মধ্যে ফেলে ভক্তদের পরিশুদ্ধ করে নিচ্ছেন৷ যেমন সঁাতার শিখতে গেলে জলে ডুবে, জল খেতে হয় অনেক সময়৷ েতমনি সংসার সমুদ্র পার হতে হলে বিপদে আপদে হাবুডুবু খেতে হয়৷ নানা বিপরীত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে খঁাটি ভক্ত হয়ে ভগবানের হাতের যন্ত্র স্বরূপ হতে হয়৷ শ্রীমা এজন্য পেছনে থেকে শক্তি যোগান৷ শ্রীমায়ের এই শক্তির প্রভাব বুঝতে পারলেই ভক্তের মঙ্গল হয়৷ ঠাকুরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলে শ্রীমাও শান্তিবোধ করেন৷ তিনি অানন্দিত চিত্তে তখন বিরাজ করেন৷ জগতের িহতার্থে যঁার আগমন তঁাকে সর্বদাই বিশ্বের কল্যাণ চিন্তা দ্বারা নিেজকে ব্যস্ত রাখতে হয়৷ স্বরূপের স্বতোৎসািরত প্রবাহে যাতে ভেসে যেতে না হয়; তার জন্যই এই সুবন্দোবস্ত৷ “আমি—মাস্টার মহাশয় বিবাহ করতে বারণ করেছিলেন। মা—আহা! নিজে অনেক কষ্ট পেয়েছেন কি-না! তাই বলেন আর ত�োরা কেউ বিয়ে করিস নি রে! ০৬২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বত্রিশ আমি—সংসারে বড় ব্যাঘাত। সংসারে থাকলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। মা—নিশ্চয়। কেবল টাকা, টাকা, টাকা। আমি—বিষম যন্ত্রণা! মা—ঠাকুরের সংসারী ভক্তও ত�ো আছে। ভাবনা কি? আমি নিস্তব্ধ হয়ে আছি। মা—আমার ভায়েরা বিবাহ করেছে। আমি—আপনার অনুমতি অনুসারে? মা—কি করব। ঠাকুর বলতেন, ‘বিষ্ঠার প�োকা বিষ্ঠাতেই ভাল থাকে, ভাতের হাঁড়িতে রাখলে মরে যাবে।’ আর আমরা খুড়�ো-জ্যাঠার সেবা শুশ্রূষা করেছি, এখনকার ভাইঝিরা তেমন করে না।” —(শ্রীপ্রবোধ ও শ্রীমনীন্দ্র, পৃঃ ১২০) সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব করে বিয়ে করতে নিষেধ করেন মাস্টারমশাই। তা নিয়ে নানা জনের নানা কথা। মাস্টারমশাই নিজে বিয়ে করে কষ্ট পেয়েছেন বলেই অন্যদের নিষেধ করেন৷ নিজের সাংসারিক তিক্ত অভিজ্ঞতা

হয়েছে, তাই এই পরামর্শ। এতে অন্যায় কিছু নেই৷ যদিও ঠাকুরের অনেক ভক্ত ছিল, তারা ত�ো দিব্য আনন্দে সংসারযাত্রা নির্বাহ করে গেছেন। বিয়ে করলে ‘টাকা, টাকা’ করে জীবনের অনেকটা মহামূল্য সময় অতিবাহিত হয়ে যায়৷ আসলে আসক্তি ও বাসনা এর জন্য দায়ী। অনেক অর্থ থাকলেই অনেক সুখ হয় না। আবার বিয়ে না করে, টাকার পিছনে না ছুটে নির্বাসনা লাভ করেছে; তাও হয় না। ঠাকুর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন— ‘বিষ্ঠার প�োকা বিষ্ঠাতেই ভাল থাকে’, সংসারে আসক্তি থাকলে বিয়ে করে সংসার প্রতিপালন করে আনন্দে থাকাই উচিত। তাদেরকে কি আর ত্যাগের কথা বললে চলে? তাদের ধীরে ধীরে ভগবানের দিকে আগাতে হয়; হঠাৎ একেবারে হয় না। তারা সংসার যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে যখন েচতনায়িত হয়, তখনই ভগবানের কাছে মাথা নত করে, শরণাগত হয়৷ তখনই সংসার হয়ে ওঠে আনন্দ ধাম—বার্ধক্যের বারাণসী!

০৬৩

০৬৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তেত্রিশ “আমার সহিত মায়ের পরিচয় হইবার কিছুদিন পরে একদিন মা আমাকে বলিলেন, “ওঁকে বল�ো যাতে আমার একটু ভাবটাব হয়, ল�োকজনের জন্য ওঁকে এ কথা বলবার আমার সুয�োগ হয়ে উঠছে না।” আমি ভাবিলাম হবেও বা; মা যখন অনুর�োধ করিতেছেন তখন ঠাকুরকে ঐ কথা বলিব। পরদিন সকালে ঠাকুর একা তক্তপ�োশে বসিয়া আছেন দেখিয়া আমি প্রণাম করিয়া তাঁহাকে মায়ের কথা বলিলাম। তিনি ঐ কথা শুনিলেন, কিন্তু ক�োন উত্তর না দিয়া গম্ভীর হইয়া রহিলেন। তিনি যখন ঐরূপ গম্ভীর হইয়া থাকিতেন, তখন কথা বলিতে কাহারও সাহস হইত না। তাই আমি কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিলাম। নহবতে আসিয়া দেখিলাম—মা পূজা করিতেছেন। দরজা একটু খুলিয়া দেখি—মা খুব হাসিতেছেন। এই হাসিতেছেন আবার একটু পরে কাঁদিতেছেন। দুই চক্ষু দিয়া ধারার বিরাম নাই। কতক্ষণ এইভাবে থাকিয়া ক্রমে স্থির হইয়া গেলেন—একেবারে সমাধিস্থা।” —(পূজনীয়া েযাগেন-মা, পৃঃ ১৩৪)

শ্রীমায়ের সঙ্গে যোগীন-মার কয়েকদিন মাত্র পরিচয় হয়েছে৷ ঠাকুরের কাছে বাইরের লোকজন থাকায় েযাগীন-মা শ্রীমায়ের ভাবসমাধি যাতে হয়—এ কথাটি বলতে পারছেন না৷ অথচ শ্রীমা যোগীন-মাকে ঠাকুরের কাছে তা বলবার জন্য বলেছেন৷ একদিন সকালে ঠাকুরকে একা পেয়ে যোগীন-মা শ্রীমােয়র সমাধি প্রসঙ্গ ঠাকুরকে নিবেদন করল৷ কিন্তু ঠাকুর গম্ভীর হয়ে নীরব রইলেন৷ অগত্যা যোগীন-মা নহবতে ফিরে এসে দেখেন, শ্রীমা পূজা করতে করতে কখনও হাসছেন, কখনো বা কাঁদছেন৷ চোখ দিয়ে দরদর ধারায় অশ্রুপাত হচ্ছে৷ পরে একেবারে নিশ্চল—সমাধিস্থা৷ শ্রীমায়ের এরূপ ভাব দেখে যোগীন-মা অবাক হয়ে​েছন৷ শ্রীমায়ের স্বরূপ সম্পর্কে যোগীনমার ধারণা তখনও সম্পূর্ণ ছিল না বলেই হয়তো বা তাঁকে শ্রীমা তা দেখিয়ে দিলেন৷ ঠাকুর এবং শ্রীমা যে একই টাকার এপিঠ ওপিঠ তাও জানিয়ে দিলেন৷ আসলে লীলাখেলার কুশীলব হতে হবে যে েযাগীন-মাকে, তাই তাকে তো পূর্ব থেকেই সব বুিঝয়ে দিতে হবে!

০৬৫

০৬৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চ�ৌত্রিশ “তারপর জনৈক সাধুকে লক্ষ্য করিয়া মা বলিতে লাগিলেন, “ঠাকুর বলতেন—‘সাধু সাবধান!’ সাধুর সর্বদা সাবধানে থাকতে হয়। সাধু সর্বদা সাবধানে থাকবে। সাধুর রাস্তা বড় পিছল। পিছল পথে চলতে হলে সর্বদা পা টিপে চলতে হয়। সন্ন্যাসী হওয়া কি মুখের কথা? সাধু মেয়েমানুষের দিকে ফিরেও তাকাবে না। চলবার সময় পায়ের বুড়�ো আঙুলের দিকে লক্ষ্য রেখে চলবে। সাধুর গেরুয়া কাপড় কুকুরের বগলসের মত�ো তাকে রক্ষা করবে। কেউ তাকে মারতে পারে না। সাধুর সদর রাস্তা। সকলেই তার পথ ছেড়ে দেয়।” “মন্দ কাজে মন সর্বদা যায়। ভাল কাজ করতে চাইলে মন তার দিকে এগ�োতে চায় না। আমি আগে রাত তিনটার সময় উঠে প্রত্যহ ধ্যান করতুম। একদিন শরীর ভাল না থাকায় আলস্যবশত করলুম না; তা কদিন বন্ধ হয়ে গেল। সেজন্য ভাল কাজ করতে গেলে আন্তরিক খুব যত্ন ও র�োক চাই। যখন নবতে থাকতুম, রাতে যখন চাঁদ উঠত, গঙ্গার ভিতর স্থির জলে চাঁদ দেখে ভগবানের কাছে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতুম—‘চন্দ্রতেও কলঙ্ক আছে, আমার মনে যেন ক�োন দাগ না থাকে।’” ০৬৭

—(স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৩৯) সন্ন্যাসীদের জীবনযাপন কেমন হবে—জগতের কল্যাণের জন্য অবতীর্ণা জগজ্জননী, তার কি অপূর্ব নিদর্শন তুলে ধরেছেন৷ বড় কঠিন পথ এই সন্ন্যাসীর; ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া’—উপনিষদোক্ত সেই অমৃতবাণী৷ ঘৃণা বা অবহেলা না করে, মেয়ে মানুষ থেকে সন্ন্যাসীকে সাবধান থাকতে হবে৷ কিভাবে পথ চলবেন? বুড়�ো আঙুলের দিকে লক্ষ্য রেখে৷ সন্ন্যাসীর গেরুয়া বসন তাকে কুকুেরর বগলসের মতো রক্ষা করবে৷ মনের স্বভাব নিয়ে অারও একটি মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন৷ মনের স্বভাব মন্দ কােজ বেশি আকর্ষণ অনুভব করা৷ কারণ ভাল কাজ করতে নানা বিঘ্ন আসে— ‘সহস্রাণি বহু বিঘ্নাণি’৷ তাই নিত্য, নিয়মিত, যথাসময়ে ভগবানের নামগুণগান করে নিেজর অন্তনির্হিত ৈদবীসত্তার অনুভব করতে হয়৷ এ যেন সেই তোতাপুরীর নিত্য ঘটিমাজার দৃষ্টান্ত৷ ঠাকুরের মতো তো আর আমাদের মন সোনার ঘটি নয়! জগতের আপামর জীবের মঙ্গল সাধনে এটি তার নির্দেশ বার্তা! এটির অবলম্বনে সর্বৈব মঙ্গল ও কল্যাণই হয়৷ ০৬৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁয়ত্রিশ “মা বলিলেন, “নির্জনে হৃষীকেশ প্রভৃতি স্থানে কিছুকাল সাধন-ভজন করে মন পাকলে তারপর মনকে যেখানেই রাখ, যে-ল�োকের সঙ্গেই মেশ�ো একরূপই থাকবে। যখন গাছ চারা থাকে তখন চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বড় হলে ছাগল গরুতেও কিছু করতে পারে না। নির্জনে সাধন করা খুব দরকার। যখন মনে ক�োন বিষয় উদিত হবে, জানবার ইচ্ছা হবে, তখন একাকী কেঁদে কেঁদে তাঁর নিকট প্রার্থনা করবে। তিনি সমস্ত মনের ময়লা ও কষ্ট দূর করে দেবেন, আর বুঝিয়ে দেবেন।” আমি—আমার ত�ো সাধন-ভজনের শক্তি নেই, আপনার পাদপদ্ম ধরে পড়ে আছি, যা হয় করুন। মা হাতজ�োড় করিয়া ঠাকুরকে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “ঠাকুর ত�োমার সন্ন্যাস রক্ষা করুন। তিনি দেখছেন, ত�োমার ভয় কি? ঠাকুরের কাজ করবে, আর সাধন-ভজন করবে, কিছু কিছু কাজ করলে মনে বাজে চিন্তা আসে না। একাকী বসে থাকলে অনেক রকম চিন্তা আসতে পারে।” —(স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৪০) মুমুক্ষু সন্ন্যাসীর প্রতি মায়ের নিদের্শিত এটি একটি নিত্য

সাধনের রোজনামচা৷ শ্রীমা বলেছেন, নির্জনে হৃষীকেশ প্রভৃতি স্থানে সাধন ভজন করে মনকে ঈশ্বর-পাদপদ্মে নিবিষ্ট করে দিতে হয়৷ ধ্যানতন্ময়তায় ডুবে থাকা মনে েকানরকম বিরূপ পরিস্থিতি বা বিপথে পা পড়ার প্রবণতা আসে না৷ ‘সাধু সাবধানে থাকবে’—ইহাই যেন তাকে প্রতিপাদিত করে৷ যে েকান বিষয়ের জ্ঞানপ্রাপ্তিেত বাধা প্রাপ্ত হলে, তঁার কাছেই েকঁদে কেঁদে প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছেন৷ নির্জনে একাকী কঁাদতে পারলেই মনের ময়লা দূরীভূত এবং অভীষ্ট পূর্ণ হয়৷ শরণাগত সন্ন্যাসী সন্তানদের সাধন-ভজনে অক্ষমতা প্রকাশে শ্রীমায়ের মমতাভরা মাতৃহদয়ের প্রার্থনা ঠাকুরের কাছে— এদের ‘সন্ন্যাস রক্ষা’ করা৷ তিনি অভয় দিয়েছেন, ঠাকুর দেখছেন, েদখবেন এবং সবদিক দিয়ে রক্ষাও করবেন৷ এছাড়া সদা সর্বদা সাধন-ভজন করতে নির্দেশ দিয়ে—অলসভাবে সময় কাটাতেও নিষেধ করেছেন৷ কাজ করলে মন ভাল থাকে৷ সন্ন্যাসীর কাজ—সাধন-ভজন ও জগতের িহতসাধনে ব্যস্ত থাকা৷ স্বামীজীর ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’েত সন্ন্যাস জন্মের সার্থকতা প্রতিপাদন করাই লক্ষ্য৷

০৬৯

০৭০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছত্রিশ “আমি বলিলাম, “মা, আমার ধ্যান যাতে ভাল হয় এবং তাতে মগ্ন হয়ে যেতে পারি, এই আশীর্বাদ করুন।” মা মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন আর বলিলেন, “সর্বদা সদসৎ বিচার করবে।” আমি—মা, বসে বসে বিচার করতে পারি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিচার আসে না; তখন ক�োথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়! শক্তি দিন যাতে সে সময় ঠিক থাকতে পারি। মা—বাবা, ঠাকুর ত�োমায় রক্ষা করবেন। তারপর বলিলেন, “ত�োমার জ্ঞান চৈতন্য হ�োক।” জনৈক সন্ন্যাসী ভক্তকে মা বলিতেছেন, “ত�োমরা সন্ন্যাসী, ত�োমাদের গৃহস্থের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখা অত্যন্ত খারাপ। বিষয়ী ল�োকদের বাতাস লাগাও খারাপ। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “নির্জনে ক�োন বাগানে কিছুদিন সাধন করতে আমার ইচ্ছে হয়।” মা—এই ত�ো করবার সময়। এই বয়সেই করতে হয়। করবে বই কি। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে। য�োগীনের (স্বামী য�োগানন্দ) কঠ�োর করে করে শেষে বড় কষ্ট পেয়ে শরীর গেল।” ০৭১

—(স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ১৪৩) শ্রীমা অভয়বাণী প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সাবধানতা অবলম্বনের কথাও মনে করিয়ে দেন৷ ধ্যানমগ্ন হতে চাওয়ার কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে সন্তানকে অাশীর্বাদ করে, সবর্দা সৎ এবং অসৎ-এর বিচার করতে বলেছেন৷ জগতে একমাত্র সৎ বস্তু হলো ভগবান, বািক সব অসৎ৷ এই বিচারকে প্রাধান্য দিয়ে জগতের েমাহিনীমায়ায় প্রলোভিত না হয়ে, একমাত্র সৎবস্তু ভগবানে মনকে আবিষ্ট রাখতে হয়৷ কার্যক্ষেত্রে বিচার আসে না৷ মহামায়ার এমনই মোহিনী মায়া! বিষয়ী লোকদের থেকে সন্ন্যাসীকে দূরে থাকতে বলেছেন৷ গৃহস্থের যা ধর্ম, সন্ন্যাসী সে বিষয়ে পরামর্শ বা প্রত্যক্ষভাবে তার উপকার করতে গিয়ে নিজের সন্ন্যাসধর্ম যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে সম্পূর্ণ সজাগ থাকবে৷ নির্জনে তপস্যা করতে চাওয়ায় সন্ন্যাসীেক উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছেন ‘এই তো বয়স’ অর্থাৎ কম বয়সের সময় রোগজ্বালামুক্ত থাকে শরীর৷ কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে খাওয়া দাওয়ার কঠোরতার দৃষ্টান্তে স্বামী যোগানন্দের শরীরপাতের কথাও বলেছেন৷ ০৭২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাঁইত্রিশ “আমি—মা, এই যে ঠাকুরকে সকলে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন বলে, তুমি কি বল? মা—হাঁ, তিনি আমার পূর্ণব্রহ্ম সনাতন। ‘আমার’ বলায় আমি বলিলাম, “তা প্রত্যেক স্ত্রীল�োকেরই স্বামী পূর্ণব্রহ্ম সনাতন। আমি সেভাবে জিজ্ঞাসা করছি না।” মা—হাঁ, তিনি পূর্ণব্রহ্ম সনাতন—স্বামিভাবেও, এমনি ভাবেও। তখন আমার মনে হইল, তিনি পূর্ণব্রহ্ম হইলে মা জগদম্বা স্বয়ং—যেমন সীতা-রাম, রাধা-কৃষ্ণ পরস্পর অভিন্ন। আমিও এই বিশ্বাস লইয়াই মাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে যে ত�োমাকে এই দেখছি যেন সাধারণ স্ত্রীল�োকের মত�ো বসে রুটি বেলছ, এসব কি? মায়া, না কি!” মা—মায়া বইকি! মায়া না হলে আমার এ দশা কেন? আমি বৈকুণ্ঠে নারায়ণের পাশে লক্ষ্মী হয়ে থাকতুম।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭০) শ্রীমায়ের সাংসারিক জীবনের কর্মব্যস্ততা ও সাধারণ গৃহস্থেরই মতো জীবনযাপন দেখে ভক্তহৃদয়ের সন্দেহ

নিরসনের জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে৷ ঠাকুর যে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন তাই নিয়ে জিজ্ঞাসা৷ শ্রীমায়ের স্বরূপও এই কথোপকথনের মাধ্যমে যাচাই করে নেওয়া হয়েছে৷ সাধারণ যে েকান নারীর কাছে তার স্বামী পূর্ণব্রহ্ম সনাতন; কিন্তু শ্রীমা বলেছেন, ঠাকুরের একই রূপ স্বামীভােবও আবার এমনিভাবেও৷ প্রতিপ্রশ্ন, তাহলে শ্রীমা কেন সাধারণ নারীর ন্যায় বসে রুিট বেলেন, এ কি মায়া? জগজ্জননী স্বীকার করেছেন—মায়া ছাড়া আর কি? তা না হলে তিনি যে েসই বৈকুণ্ঠে নারায়ণের পাশে লক্ষ্মী হয়ে বসে থাকতেন৷ জগতের কল্যাণের জন্য নরলীলায় তাঁদের মর্ত্যধামে অবতরণ করতে হয়েছে৷ জগৎবাসীর সুখ-শান্তি-আনন্দে থাকার পথ নির্দেশিকা রূপে ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে িশখায়’ করে দেখালেন৷ অভিনয় করতে গিয়ে কখনো কখনো বা নিজের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ তখন জগতের কাছে তা অলীক বলে প্রতিভাত হয়৷ আশ্চর্য লাগে যখন কিনা সাধারণ হয়েও তাঁদের অসাধারণত্ব বাস্তবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে৷ ঐশ্বর্যলীলার স্ফূরণে এরকমই ঘটে থাকে৷

০৭৩

০৭৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটত্রিশ “মা—মন্ত্রের দ্বারা দেহশুদ্ধি হয়। ভগবানের মন্ত্র জপ করে মানুষ পবিত্র হয়। ইহা বলিয়া একটি গল্প বলিলেন— নারদ বৈকুণ্ঠে গিছলেন। বসে ঠাকুরের সঙ্গে অনেক কথা কইলেন। নারদ যখন চলে গেলেন, ঠাকুর লক্ষ্মীকে বললেন, ‘ওখানে গ�োবর দাও।’ লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন, ঠাকুর? নারদ যে পরম ভক্ত, তবে কেন এরূপ বলছ।’ ঠাকুর বললেন, ‘নারদের এখনও মন্ত্র নেওয়া হয়নি। মন্ত্র না নিলে দেহ শুদ্ধ হয় না।’ অন্ততঃ দেহশুদ্ধির জন্যও মন্ত্র দরকার। বৈষ্ণবেরা মন্ত্র দিয়ে বলে, “এখন মন ত�োর।” তাই ত�ো— “মানুষ গুরু মন্ত্র েদন কােন৷ জগদ্গুরু মন্ত্র দেন প্রাণে৷৷” মনেতেই সব। মন শুদ্ধ না হলে কিছুই হয় না। “গুরু, কৃষ্ণ, বৈষ্ণব, এ তিনের দয়া হল৷ একের দয়া বিনে জীব ছারখারে গেল৷৷” একের কি না মনের। নিজ মনের কৃপা হওয়া চাই।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭২-১৭৩)

মন্ত্রদীক্ষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে এখানে পুরাণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে৷ ভগবানের মন্ত্র জপ করলে দেহশুদ্ধি হয়৷ ভগবানের পবিত্র নােমর গুণে মনোমল দূরীভূত হয়ে দেহশুদ্ধি হয়৷ েযমন কিনা—সাবানে গায়ের ময়লা পরিষ্কার হয়৷ পরমভক্ত নারদের মন্ত্রগ্রহণ হয় নি বলে তিনি যে স্থানে বসে নারায়ণের সঙ্গে কথা বলেছেন, নারদ চলে যেতে েসই স্থানের শুদ্ধিকরণ করা হয়েছে৷ ৈবষ্ণবশাস্ত্রে মন্ত্রগ্রহণ প্রসঙ্গ বলা হয়েছে—মানুষ গুরু কােন মন্ত্র দেন অার জগদ্গুরু মন্ত্র দেন প্রাণে৷ মনে​েতই সব, মন শুদ্ধ হলে আর কিছুই দরকার হয় না৷ আবার এও বলা হয়েছে, গুরু, কৃষ্ণ এবং ৈবষ্ণবের দয়া হলেও একের অর্থাৎ মনের দয়া না হওয়ায় জীব ছারখার হয়ে যায়৷ আসলে মানুষের আচার, অাচরণ, রুিচর পার্থক্যই তােক ভগবানের সান্নিধ্যে বা দূরে নিক্ষেপ করে৷ মনের মধ্যে যে সব কামনা বাসনা থাকে তা পূরিত না হলে অন্যায়ভাবে তা পূরণের চেষ্টা হয়৷ ফলে পাপাচারণ করতে বাধ্য হয়ে পড়ে৷ তখন মনের দাস হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না৷ কিন্তু মন্ত্র মনকে দাস বানায়৷

০৭৫

০৭৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনচল্লিশ “নিজের কথা বলিতেছেন—“বলরামবাবু বলতেন, ‘ক্ষমারূপা তপস্বিনী’।” বলিয়াই আবার বলিলেন, “দয়া যার শরীরে নেই, সে কি মানুষ? সে ত�ো পশু। আমি কখন কখনও দয়ায় আত্মহারা হয়ে যাই, ভুলে যাই যে আমি কে।” কথাবার্তার শেষে মা বলিলেন, “বাবা, ত�োমার সঙ্গে আমার যেমন খ�োলাখুলি কথা হয়েছে এমন আর কারও সঙ্গে হয়নি।” পরে মা বলিলেন, “আমি যখন কলকাতায় যাব তখন তুমি আসবে, আমার কাছে থাকবে।” যদিও আমার ভিতরে ভিতরে সাধু হইবার খুব ইচ্ছা, তথাপি আমি তখন বাড়িতে থাকি। মনে ভাবিলাম, হয়ত�ো ভবিষ্যতে মায়ের ইচ্ছায় আমার তাঁহার কাছে থাকা এবং সাধু হওয়া সম্ভব হইবে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৪) ভক্তবর বলরাম বসুর েচাখে শ্রীমা ছিলেন ‘ক্ষমারূপা তপস্বিনী’৷ শ্রীমায়ের ক্ষমা করা এবং তপস্বিনীর জীবনযাপন করা—দুই ক্ষেত্রেই তিনি চরমোত্তীর্ণা৷ অবতার সঙ্গিনী হিসাবে জগতে অবতীর্ণা হয়েও কত রূপে জীবের অবহেলা সহ্য করেছেন—তবু তাদের ক্ষমা করেছেন৷ ঠাকুর হৃদয়রামকে

বলেছিলেন, ওকে (শ্রীমােক) তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করতে৷ কারণ শ্রীমা একবার যদি কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হন, ত্রিজগতে েকউ নেই যে তােক রক্ষা করে৷ েসই শ্রীমা পদে পদে ক্ষমা করে চলেছেন৷ প্রচণ্ড দ�ৌর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়েও কল্যাণ মূর্তিেত সদা বিরাজ করেছেন৷ আর তপস্বিনী! েস তো অহরহই দৃশ্যমানা৷ জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বরের জীবনযাপন সবটাই তপস্যার জীবন৷ আমোদরে দলঘাষ কাটা, মুনিষদের মুড়ি নিয়ে যাওয়া, ছোট ছোট ভাইদের মানুষ করা৷ অার দক্ষিণেশ্বরের নহবতে বাস! কি অপরিসীম ধৈর্য্য সহকারে কালাতিপাত৷ এরই মধ্যে ভোর তিনটেয় উঠে জপধ্যানাদিতে সময় অতিবাহিত করা ইত্যাদি ইত্যাদি কত ঘটনারই না উল্লেখ করা যেতে পারে৷ শ্রীমা যখন কাউকে কৃপা করতেন, তার সঙ্গে অতি আপনজনের মতো মিশতেন৷ মাতৃহারা সন্তান তাঁকে নিজ জননীরূপে কাছে েপত, রোগী সুিচকিৎসকরূপে তাঁর সেবা পেত৷ আধ্যাত্মিক জ্ঞানপিপাসু ভক্ত তাঁকে অধ্যাত্মরাজ্যের সম্রাজ্ঞীরূেপ অনুভব করত৷ অাবার সঙ্ঘের জননীরূেপ সর্বদা তঁার অবস্থান স্মরণ করত৷ শ্রীরামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত মিশনের তিনিই একমাত্র রক্ষাকর্ত্রী এবং পালনকর্ত্রী৷

০৭৭

০৭৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চল্লিশ “আমাকে বলিলেন, “কামারপুকুরে এক-আধ দিন থেকে শেষে মঠে যাবে। ঠাকুরের জন্মস্থান হয়ে যেতে হয়।” আমার কিন্তু কামারপুকুরে যাইবার পরিকল্পনা ছিল না। আমি শুধু মাকে দেখিতেই গিয়াছিলাম। তাঁহার জন্যই ব্যাকুল হইয়া বাড়ি হইতে ছুটিয়াছিলাম; সঙ্গে কাপড়, ছাতাটি পর্যন্ত আনিতে ভুল হইয়াছিল। কিছুদূরে আসিয়া মনে পড়িলেও আর ফিরি নাই, পাছে ক�োন বিঘ্ন ঘটে। আমার সঙ্গে কাপড় ছিল না। মা একখানি কাপড় পরিতে দিয়াছিলেন। বলিলেন, “ওখানা সঙ্গে নিয়ে যাও।” জিজ্ঞাসা করিলেন, “সঙ্গে টাকা আছে? গাড়ি-ভাড়া এসব লাগবে, টাকা নিয়ে যাও।” আমি বলিলাম, “আমার কাছে টাকা আছে, নিতে হবে না।” বলিলেন, “গিয়ে পত্র লিখবে।” মা বলিতেছেন, “আমার ছেলেটিকে কিছুই খাওয়াতে পারলুম না, মাছ ধরাতে পারিনি।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৭) জয়রামবাটীেত মাতৃসান্নিধ্যে অবস্থানের পর গৃহে ফিরে যােব ভক্ত সন্তান৷ তাকে শ্রীমা কামারপুকুর দর্শন করে যাওয়ার জন্য আদেশ করেছেন৷ কামারপুকুর ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র তাই পবিত্র ও পুণ্যভূমি৷ এত কােছ এসে তা না ০৭৯

দর্শন করে যাওয়াটা ভাল না৷ ভক্তের মঙ্গলের জন্য শ্রীমায়ের কি দরদ৷ পুণ্যভূমি স্থান বা পবিত্র স্থানে উপস্থিত হলেই নিজেকে পবিত্র করে নিতে পারা যায়৷ পাথেয় আছে কি না, তাও খবর নিচ্ছেন, সঙ্গে পরার কাপড় িছল না, তাও দিয়েছেন—এরূপে মাতৃহৃদয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিেয়ছেন৷ অাসলে ‘েস যে েতামার আমার মা শুধু নয়, জগতের মা সবাকার, বায়ুরূপে বাতাস করে অনিবার’—তঁার জগতে তঁাকেই তো সব কিছু করতে হবে; করছেনও তাই৷ ভক্ত সন্তান গৃহে ফিরে যাচ্ছে৷ তাকে মাছ ধরে খাওয়াতে না পারায় খেদ প্রকাশ করেছেন৷ বাড়িেত ফিরে পত্র েদবার অঙ্গীকার করিয়ে নিচ্ছেন৷ এভাবে অাপন করে নেওয়ার কি ক্ষমতাই না ছিল তঁার! জননীরূেপ তিনি সন্তানের পালন, শাসন এবং অাধ্যাত্মিক জীবন গঠনে তথা সার্বিক উন্নতিতে সদা বর্তমান থাকা, শ্রীমায়ের কাছে স্বাভাবিক বলেই এমন অচিন্ত্যনীয় পরিব্যপ্তি বিস্ময় জাগায়৷

০৮০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একচল্লিশ “তাহাদের সহিত আমরা জয়রামবাটী পৌঁছিলাম। বাড়ির মধ্যে গিয়া মাকে বলিলাম, ‘মা, এসেছি।’ মা খুব খুশি হইয়া বলিলেন, “বেশ করেছ, এদের সঙ্গে যাবে।” শিবচতুর্দশী উপলক্ষে ঘাটালের উকিল শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখ�োপাধ্যায় আসিয়াছেন। ভক্তদের কেহ কেহ উপবাস করিয়াছেন। পরদিন মধ্যাহ্নে তাঁহারা মায়ের প্রসাদ চাহিলে মা রাধুকে দিয়া একটি শালপাতায় করিয়া প্রসাদ পাঠাইলেন। সকলে খাইতেছেন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এ কি খাচ্ছেন’? তাঁহারা বলিলেন, ‘মায়ের প্রসাদ’। তখন আমিও একটু খাইলাম। মাকে গিয়া বলিলাম, “মা, এঁরা সব ত�োমার প্রসাদ খাচ্ছেন, তা আমাকে এত দিন দাও নাই কেন?” মা বলিলেন, “বাবা, তুমি ত�ো চাওনি, আমি কি করে বলি?” কি নিরহঙ্কার ভাব!” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৭৮) ‘মায়ের প্রসাদ’ চেয়ে খেতে হয়৷ না চাইলে তা পাওয়া যায় না৷ ভক্তের আগ্রহ দেখেই শ্রীমা তা প্রদান করতেন৷ না চাইলে কাউকে তিনি দিেতন না৷ ‘মা এসেছি’ বলে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি খুশি হতেন৷ কারও ভাব নষ্ট করতেন না৷ অন্যেরা

মায়ের প্রসাদ খাচ্ছেন, েদখে অপর একজনেরও তা গ্রহণ করার ইচ্ছা হয় এবং মায়ের কাছেই অপ্রাপ্তির অনুেযাগ করলে তিনি বলেন, ‘তুিম তো চাওনি’৷ এতে তঁার নিরহঙ্কারতাই প্রকাশ পেয়েছে৷ প্রয়োজনীয় বস্তুটি ভগবানের কাছে চেয়ে নিতে হয়, যা ‘প্রার্থনা’ নামেই পরিচিত৷ ভগবান যা ভাল বুঝবেন, তাই করবেন৷ আবেদন নিবেদন করলে, যথাসময়ে তিনি তা পূরণ করেন৷ সবই তঁার ইচ্ছা৷ প্রসাদে সব দুঃখের নিরসন হয়৷ গীতাতেও বলা হয়েছে “প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে৷ / প্রসন্নচেতসা হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে”৷ প্রসাদ লাভ করলে সব দুঃখের শান্তি হয় এবং বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্রই আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ গীতার আত্মপ্রসাদের কথা বলা হলেও এখানে শ্রীমােয়র প্রসাদেও একই ফল হয়ে থাকে৷ প্রসাদধারণে চিত্তের প্রসন্নতায় শ্রীভগবােনর স্মরণ-মনন করে জীব পরমানন্দ পেতে পারে৷ হৃৎমাঝাের আত্ম-জ্যোতির স্ফূরণ হলে জীব িচরমুিক্তর পথে এগিয়ে যাবে৷

০৮১

০৮২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বিয়াল্লিশ “কথায় কথায় মাকুর শ্বশুরবাড়ির কথা উঠিল। মা বলিলেন, “তাদের খুব আদর-যত্ন না করলে একটুতেই ফোঁস করে। ত�োমরা আমার ছেলে, ত�োমাদের আমি যা দিই, যা বলি, তাতে কিছু হয় না, ত্রুটি হলেও ত�োমরা কিছু মনে করবে না, কিন্তু তাদের ভাল জিনিস, ভাল সব না দিলে, একটু ত্রুটি হলে অমনি অসন্তুষ্ট হবে।” কিছুক্ষণ পরে আমি বলিলাম, “শুদ্ধ মন আর অনুরাগ কিসে হয়?” মা—হবে, হবে; যখন ঠাকুরের শরণাগত হয়েছ, সব হবে। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে। আমি—না, সে তুমি তাঁকে বলবে? মা—আমি ত�ো বলছি, ঠাকুর, আমার এর মনটি ভাল করে দাও, শুদ্ধ করে দাও। আমি—হাঁ, তুমি বলবে, তাহলেই আমার হবে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮০) শ্রীমায়ের সংসারের একটি সাংসািরক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে৷ অাপন আর পর৷ যারা অাপনজন, তাদেরকে যা েদওয়া হয়, তাতেই তােদর অানন্দ ও খুশি, কিন্তু কুটুম্ব,

তারা তা মেনে নেয় না; তাই তারা পর৷ এমনই একটি পরিবার মাকুর শ্বশুর বাড়ি৷ তাদের সব সেরা জিনিস দিতে হয়৷ তাই নিয়ে শ্রীমায়েরও িচন্তা থাকে৷ এই বুঝি েকান খুঁট ধরে বসে এবং অশান্তি সৃষ্টি করে৷ এমন সব মানুষদের নিয়েই শ্রীমাকে সংসার প্রতিপালন করতে হয়৷ আসলে কামনা বাসনার পারে যে​েত না পারলে জাগতিক েকান বস্তুেত ‘সুখ’ পাওয়া যায় না৷ তার উপরে ভিখিরি-স্বভাব হলে েতা কথাই নেই৷ যতই দাও না কেন—অভাব েকান দিনই যাবে না৷ এরা সুখ কাকে বলে তা জানতেই পারে না, ‘শািন্ত’ তা তো বহু দূরের কথা৷ শুদ্ধ মন এবং অনুরাগ কিেস হয়—তার উত্তরে ঠাকুেরর শরণাগত হওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ ঠাকুরের শরণাগত হলে তিনি তাঁর ভক্তকে রক্ষা করেন সর্বতোভাবে৷ তার ইহল�ৌিকক ও পারল�ৌকিক সব ভার তিনি নেন৷ জীবনের সঠিক পথের দিশাও েদখান৷ তাই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, মনটি শুদ্ধ কর যাতে তা ভগবানের পাদপদ্মে অচলা ভক্তিতে স্থিত থাকে৷

০৮৩

০৮৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তেতাল্লিশ “মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় দ্বারের সম্মুখে বসিয়া পান সাজিতেছিলেন। বেলা প্রায় নয়টা। আমাকে মুড়ি খাইতে দিয়াছেন। খাইবার পর কথা হইতেছে। আমি—মা, এবার আমাকে বেশি দিন রেখ�ো না। মা—থাকতে ইচ্ছা না হয় আমার সঙ্গে যাবে। সময় হলে (দেহান্তে) সকলে (সব ভক্তরা) যাবে। আমি—এবার আমাকে নিয়ে যাও, পরবারে ঠাকুর যখন আসবেন তখন সঙ্গে আসব। মা হাসিয়া বলিলেন, “আমি ত�ো আর আসছি না।” আমি—তুমি আস আর না আস, আমি আসব, আমার আসতে ইচ্ছা আছে। মা—তুমি তখন হয়ত�ো আর আসতে চাইবে না। এ জগতে কি আর আছে? ক�োন্ জিনিসটা ভাল, বল না? তাই ঠাকুর সজনে খাড়া (ডাঁটা), পলতা শাক, এই সব ছাড়া আর কিছু খেলেন না। মুখে সন্দেশ দিতে যেতুম, বলতেন “ওতে কি আর আছে? সন্দেশও যা, মাটিও তা।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮২)

অবতারের লীলাভিনয়ে পার্ষদেরা কলমীর দলের ন্যায় এক সঙ্গে অবতীর্ণ হন৷ শ্রীমায়ের কাছে ভক্তের তাই আবদার বেিশ দিন এবারে মর্ত্তে থাকতে ইচ্ছা নেই, পরের বারে ঠাকুরের সঙ্গে আসবে৷ শ্রীমায়ের জবাব েদহান্তে সব ভক্তই ঠাকুরের কাছে ফিরে যােব, িক অপূর্ব কথা৷ আমােদর আর কারও িচন্তা করার দরকার নাই—শেষ সময়ে এসে ঠাকুর েদখা দেবেন এবং সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন৷ সহাস্য শ্রীমােয়র উত্তর তিনি কিন্তু আর আসতে নারাজ৷ জগতে আছে কি? সব অসার, তাই ঠাকুর শুধু সজনে ডঁাটা আর পলতা শাক ছাড়া কিছু খে​েতন না৷ সন্দেশ দিলে বলতেন, মাটি আর সন্দেশে পার্থক্য কি? অর্থাৎ সমত্ব র্দশন৷ মায়াময় রাজত্বে সবই যে অসার, তা েবাধে েবাধ করেছেন৷ তাই সাধারণ মানুষের মতো বিষয় ভোগের সুখ থেকে বহুদূরে অবস্থান করেছেন৷ জগতের যিনি অধিকর্তা, তিনি কি আর সবার মতো হবেন—তাই এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে!

০৮৫

০৮৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চুয়াল্লিশ “ইহার পরে আমি জপতপের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। মা বলিলেন, “জপতপের দ্বারা কর্মপাশ কেটে যায়। কিন্তু ভগবানকে প্রেমভক্তি ছাড়া পাওয়া যায় না। জপ-টপ কি জান? ওর দ্বারা ইন্দ্রিয়-টিন্দ্রিয়গুল�োর প্রভাব কেটে যায়।” ললিতবাবুর (চাটুজ্যে) কথা উঠিল। কয়েক মাস যাবৎ তাঁহার খুব ব্যারাম, সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। মা তাঁহাকে খুব ভালবাসেন এবং তাঁহার জন্য বিশেষ চিন্তিত আছেন। বলিতেছেন, “ললিত আমাকে কত টাকা দিত। তার গাড়িতে করে বেড়াতে নিয়ে যেত। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সেবায় ও (কামারপুকুরে) রঘুবীরের সেবায় অনেক টাকা দেয়। আমার ললিতের লাখ টাকার প্রাণ। অনেকে টাকা থেকেও কৃপণ।” পরে বলিলেন, “যার আছে সে মাপ�ো, যার নেই সে জপ�ো।” (যার অর্থাদি আছে সে ভক্ত-ভগবানের সেবা করুক। আর যার নেই সে ভগবানের নামজপ করুক। এই উভয় উপায়েই ভগবানের কৃপা লাভ করা যায়।)” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৪) শ্রীমা বলেছেন, জপ-ধ্যােনর দ্বারা শ্রীভগবানকে পাওয়া যায় না৷ তাহলে এত জপ-ধ্যান করার কি প্রয়োজন? শ্রীমা ০৮৭

বলেছেন, জপ-ধ্যান করলে ইন্দ্রিয়ের কু-প্রভাব কেটে যায়৷ যে মনে ভগবােনর চিন্তা করা হয় তা অশীলিত ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে অনিত্যবস্তুতে মরুিচকার ন্যায় ছুটাতে থাকে৷ একমাত্র প্রেমাভক্তিতে ভগবানলাভ হয়৷ ঈশ্বরে সম্পূর্ণরূপে মনকে লয় করতে হয়—আর তখনই অনুভব হয়, ভগবান ছাড়া জগতে আর কিছু নেই৷ অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে শ্রীমায়ের পরামর্শ ‘যার আছে েস মাপো, যার েনই সে জপো’৷ ভক্ত ললিতবাবুর সঙ্কটাপন্ন অবস্থার কথা শুেন শ্রীমা আক্ষেপ করেছেন৷ কারণ, ললিতবাবু দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সেবায় এবং কামারপুকুরে রঘুবীেরর েসবায় অনেক অর্থাদি ব্যয় করেছেন৷ শ্রীমায়ের সেবায় েতা দিতেনই৷ তাই তাঁর মতে টাকা থাকলে ভক্ত ভগবােনর সেবা করা উচিত এবং না থাকলে ভগবানের নাম জপ করে কর্মপাশ কাটিয়ে ঈশ্বরলাভের মাধ্যমে মনুষ্যজীবনকে সার্থক করতে হবে৷

০৮৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁয়তাল্লিশ “কথাপ্রসঙ্গে মা বলিলেন—“ভগবানকে কে বাঁধতে পেরেছে বল না। তিনি নিজে ধরা দিয়েছিলেন বলে ত�ো যশ�োদা তাঁকে বাঁধতে পেরেছিল, গ�োপগ�োপীরা তাঁকে পেয়েছিল। “বাসনা থাকতে জীবের যাতায়াত ফুরায় না, বাসনাতেই দেহ হতে দেহান্তর হয়। একটু সন্দেশ খাবার বাসনা থাকলেও পুনর্জন্ম হয়। তাই ত�ো মঠে এত জিনিস আসে। বাসনাটি সূক্ষ্ম বীজ—যেমন বিন্দুপরিমাণ বটবীজ হতে কালে প্রকাণ্ড বৃক্ষ হয়, তেমনই। বাসনা থাকলে পুনর্জন্ম হবেই, যেন এক খ�োল থেকে নিয়ে আর এক খ�োলে ঢুকিয়ে দিলে। একেবারে বাসনাশূন্য হয় দু-একটি। তবে বাসনায় দেহান্তর হলেও পূর্বজন্মের সুকৃতি থাকলে চৈতন্য একেবারে হারায় না।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৫) ভক্ত ও ভগবােনর লীলাকথার বর্ণনা প্রসঙ্গে শ্রীমা বলেছেন, ভগবানকে বঁাধতে পারা যায় না, ভগবান ধরা দিলে, তবেই তাঁকে ধরতে পারা যায়৷ এখানে দ্বাপরযুগে যশোদা এবং েগাপ-গোপীদের কথা উপমা স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে৷ বাসনা

থাকতে জীবের মর্ত্যধামে যাতাযাত শেষ হয় না৷ সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা কি অনুপম৷ সামান্য একটু সন্দেশ খাওয়ার বাসনা থাকলেও আবার ধরাতে জন্মগ্রহণ করতে হয়৷ বাসনার বীজ খুব সূক্ষ্মাকারে থেকে যায়৷ যেমন বটগাছের এতটুকু বীজ েথকে কি বিশাল বটবৃক্ষ হয়ে দঁাড়ায়৷ শ্রীমা বলেছেন, তাই মঠে এত সব জিনিস পত্র আসে৷ যার যা বাসনা, তা পূরণ করে নিেত হয়৷ যার খাওয়ার বাসনা; েস খাবে৷ যার পরার বাসনা; েস ভাল ভাল জামা কাপড় পরবে৷ যার যা প্রয়োজন তা সব পূরণ হয়ে যায়৷ অবশ্য বলে দিেলন, দুএকজনের বাসনাশূন্য জীবনও হয়৷ আবার এও বলেন, যাদের পূর্বজন্মের সুকৃিত থাকে, তাদের এজন্মে ৈচতন্য হারায় না৷ ৈচতন্য থাকলে েকন তার মুক্তি হলো না, কি অসুবিধা ছিল, কি ভুল করেছিল—তা সে বুঝতে পারে৷ ফলে এ জীবনে অাগে আগে থেকেই সে সাবধান হতে পারবে৷ ভরত রাজার মতো হরিণ হয়েও পূর্বজন্মের সুকৃিত বশে তার অধোগতির কারণ বুঝেছিল৷

০৮৯

০৯০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছেচল্লিশ “আমি—মা, যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তবে জগতে এত দুঃখকষ্ট কেন? তিনি কি দেখছেন না? তাঁর কি এসব দূর করবার শক্তি নেই। মা—সৃষ্টিই সুখদুঃখময়। দুঃখ না থাকলে সুখ কি ব�োঝা যায়? আর সকলের সুখ হওয়া সম্ভব কি করে? সীতা বলেছিলেন রামকে, ‘তুমি সকলের দুঃখকষ্ট দূর করে দাও না কেন? রাজ্যে যত প্রজা ল�োকজন আছে সকলকে সুখে রাখ। তুমি ত�ো ইচ্ছা করলেই পার।’ রাম বললেন, ‘সকলের সুখ একসঙ্গে কি হয়?’ ‘না, তুমি ইচ্ছা করলেই হয়, যার যা অভাব হয় রাজভাণ্ডার হতে দিয়ে দাও।’ “চিরদিন কেউ সুখী থাকবে না, সব জন্ম কারও দুঃখে যাবে না। যেমন কর্ম তেমন ফল, তেমন য�োগায�োগ হয়।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৭-১৮৮) জগতে সুখ ও দুঃখ, আলো-অন্ধকােরর ন্যায় বর্তমান৷ এই বৈপরীত্য দরুণই জগৎ এত মধুময়৷ ক্ষুধার জ্বালা আছে বলেই তার নিবৃত্তি খাওয়াতে এত আনন্দ৷ একটিই যদি

থাকত, অন্যটির বোঝা যেত না৷ েকবলমাত্র সুখ বা দুঃখ হয় না৷ এরা একই মুদ্রার এ-পিঠ এবং ও-পিঠ৷ তাই সুখ চাইলে দুঃখ বা কষ্টকে অস্বীকার করার উপায় নেই৷ বরং সুখ এবং দুঃখ একে অপরের পরিপূরক, চক্রবৎ এরা পরিবর্তনীয়৷ ভক্ত দুঃখ পেলে তবেই সুখের জন্য লালায়িত হয়৷ শ্রীমা সুন্দরভাবে এটি বুঝিয়েছেন৷ দুঃখ না থাকলে সুখের মহিমা বোঝা যায় না৷ একসময় সীতাদেবী রামচন্দ্রকে জগতের দুঃখ দূর করবার জন্য প্রজােদর যার যা প্রয়োজন, তাই রাজকোষ থেকে দিয়ে েদওয়ার জন্য বলায় রামচন্দ্র তাই করলেন৷ একসময় রামচন্দ্রের প্রাসাদের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল পড়ছে দেখে মজুর ডাকার দরকার হয়৷ কিন্তু েকাথায় মজুর৷ সবারই েতা অভাব পূর্ণ হয়েছে৷ তাই তার কর্মবিমুখ৷ তখন সীতা দেবীর ভুল ভাঙে৷ বোঝেন সকলের একসাথে সুখ হওয়া সম্ভব নয়৷ তখন যা পূর্বে ছিল ‘তাই হোক’ বলায় জগৎ আবার আগের মতো চলতে শুরু করে৷ যার েযমন কর্ম তার তেমন ফল পেলে তবেই জগতের লীলাখেলা ঠিকঠিক চলতে থাকবে৷ জগতের এই অমোঘ নিয়মই চলে আসছে এবং চলবে; এ অপরিবর্তনীয়৷

০৯১

০৯২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতচল্লিশ “মা—তাঁর কাছ থেকে যে আবার বাসনা কর্মানুসারে পৃথিবীতে এসে জন্মায়। এখান থেকে কেউ বা মুক্তিলাভ করে, কেউ বা নীচ য�োনি সব ভ�োগ করে। চক্রের মত�ো সৃষ্টি চলছে। যে জন্মে মন বাসনাশূন্য হয়, সেইটি শেষ জন্ম। আমি—যাদের গয়ায় পিণ্ডাদি না হয়, তাদের কি গতি হয়? মা—যতদিন না বংশে ক�োন ভাগ্যবান জন্মে গয়ায় পিণ্ড দেয়, কি ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়াদি করে, ততকাল প্রেতদেহে থাকতে হয়। আমি—এই যে ভূত প্রেত, এসব কি শিবের চেলা ভূত? না যারা মরে গেছে তারা। মা—না, মৃত যারা তারা; শিবের চেলা ভূত, সে সব আছে আলাদা। “ভারী সাবধানে চলতে হয়। প্রত্যেক কর্মের ফল ফলে। কাউকে কষ্ট দেওয়া, কটু বলা ভাল নয়।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৮৯) বড় জটিল এই কর্মফলের হিসাব-নিকাশ৷ বাসনামুক্ত হওয়া সহজ নয়৷ কর্ম অনুসাের জন্মগ্রহণ হয় মানুষের৷ শুভ কর্ম

করলে শুভ ফল হয়, আর অশুভ কর্ম করলে তার ফলও অশুভই হয়৷ এ জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভ করতে চাইলে বাসনাশূন্য হতে হবে৷ মৃত্যুর পর গয়ায় িপণ্ডাদি না দিলে প্রেত যোনি ভোগ করতে হয়৷ হিন্দুধর্মের চিরাচরিত প্রথানুসারে এই পিণ্ডদােনর ব্যবস্থা চলে আসছে৷ বংশের কোন ভাগ্যবান পিণ্ডদান বা ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়া করলে তাদের মুক্তি হয়৷ মৃতের ভূত আর শিেবর চেলা ভূত—সম্পূর্ণ পৃথক৷ তাই সাবধানে কর্ম করতে বলা হয়েছে৷ প্রত্যেক কর্মের ফল রয়েছে৷ ব্যবহািরক জীবনে কাউকে কষ্ট দেওয়া ভাল নয়৷ কারণ, কষ্ট দেওয়া কর্মের ফলও কষ্টকর হবে৷ শাস্ত্র বাক্য েজনেও আমরা তা সব সময় মেনে চলতে পারি না৷ এ যেন দুর্যোধনের অবস্থা! ধর্ম কি অধর্ম কি, সবই সে জানে, কিন্তু তঁার ধর্মে রুিচ ছিল না৷ কষ্ট দিলে মানুষের কষ্ট হয়, জেনেও কষ্ট দিয়ে থাকি৷ এই কর্মের ফলাফল বিচার কিরকম ভাবে হয় তা জানা থাকলে েবাধ হয় জগতে এই নিয়ম-অনিয়ম, পাপপুণ্য, ন্যায়-অন্যায় এর বাছ বিচার সহজ হত৷

০৯৩

০৯৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটচল্লিশ “ব�োধগয়ায় মঠ, তাদের অত সব জিনিসপত্র, ক�োন অর্থের অভাব নেই, কষ্ট নেই—দেখে কাঁদতুম, আর ঠাকুরকে বলতুম, ‘ঠাকুর, আমার ছেলেরা থাকতে পায় না, খেতে পায় না, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের যদি অমন একটি থাকবার জায়গা হত�ো!’ তা ঠাকুরের ইচ্ছায় মঠটি হল�ো।” “একদিন নরেন এসে বললে, ‘মা, এই ১০৮ বিল্বপত্র ঠাকুরকে আহুতি দিয়ে এলুম, যাতে মঠের জমি হয়। তা কর্ম কখন�ো বিফলে যাবে না। ও হবেই একদিন’।” রাত্রে খাইবার পর উপরে পান আনিতে গিয়া শুনি, মা বলিতেছেন, “নরেন বলছিল, ‘মা, আমার আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে। সব দেখছি উড়ে যায়।’ আমি বললুম (হাসিয়া বলিতেছেন), ‘দেখ�ো, দেখ�ো, আমাকে কিন্তু উড়িয়ে দিও না!’ নরেন বললে, ‘মা, ত�োমাকে উড়িয়ে দিলে থাকি ক�োথায়? যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে ত�ো অজ্ঞান। গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে জ্ঞান দাঁড়ায় ক�োথায়’?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯০) শ্রীরামকৃষ্ণের নামে যারা ‘নিজের মুক্তি ও জগতের

কল্যাণের জন্য’ গৃহ ত্যাগ করেছে, তাদের যাতে দুবেলা অন্নের কষ্ট না থাকে তার জন্য শ্রীমা বোধগয়ার মঠের ঐশ্বর্য েদখে ঠাকুরের কােছ কেঁদে কেঁদে একটি মঠের জন্য প্রার্থনা করেছেন৷ ঠাকুর তার মান েরখেছেন৷ তাই তো অাজ সঙ্ঘের এত সুখ ও সুবিধা৷ নরেন ১০৮ বিল্বপত্র ঠাকুরের নামে আহুতি দিয়েছেন, তাই মঠের জমি হলো৷ অাসলে কোন কর্মই বিফলে যায় না৷ শ্রীমাকে নরেন বলেছে, তার সব কিছু উড়ে যাচ্ছে৷ শ্রীমা হেসে বলেছেন, ‘দেখো, েদখো, আমাকে যেন উড়িয়ে দিও না’৷ নরেনের প্রত্যুত্তর, ‘যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় েস তো অজ্ঞান, তাহলে জ্ঞান দাঁড়ায় কোথায়৷’ ভক্তের কাছে গুরুর শ্রীচরণই ভরসা৷ গুরুর কৃপাতেই ভক্তের সব কিছু৷ গুরু শক্তিেত বলীয়ান হয় ভক্ত৷ এ গুরুপরম্পরাপ্রাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে কেউ কি আর তা থে​েক দূরে যে​েত পারে! শ্রীমা সর্বশক্তিময়ী, তঁার কৃপাকটাক্ষে পর্বতও নড়ে বসে৷ তাই সদা সর্বদা শ্রীমােয়র কাছে এই প্রাথর্না করতে হবে— ‘কৃপাকটাক্ষ কুরু েদবী নিত্যম্’৷

০৯৫

০৯৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনপঞ্চাশ “তাঁকে কখন�ো নিরানন্দ দেখিনি। পাঁচ বছরের ছেলের সঙ্গেই বা কি, আর বুড়�োর সঙ্গেই বা কি, সকলের সঙ্গে মিশেই আনন্দে আছেন। কখন�ো বাপু নিরানন্দ দেখিনি। আহা! কামারপুকুরে সকালে উঠেই বলতেন, ‘আজ এই শাক খাব, এইটি রেঁধ�ো।’ শুনতে পেয়ে আমরা (মা ও লক্ষ্মীদিদির মা) সব য�োগাড় করে রাঁধতুম। কয়েক দিন পরে বলছেন, ‘আঃ, আমার একি হল�ো? সকাল থেকে উঠেই কি খাব, কি খাব! রাম রাম!’ আমাকে বলছেন, ‘আর আমার কিছু খাবার সাধ নেই, ত�োমরা যা রাঁধ, যা দেবে, তাই খাব।’ শরীর সারতে দেশে যেতেন। দক্ষিণেশ্বরে থাকতে খুব পেটের অসুখে ভুগতেন কিনা। বলতেন, ‘রাম রাম! পেটটা কেবল মলেই ভর্তি, কেবল মলই বেরুচ্ছে।’ এই সবে তারপর শরীরে ঘেন্না ধরে গেল, আর শরীরের যত্ন করতেন না।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯২) শ্রীশ্রীঠাকুেরর কি অপূর্ব জীবনকথা বর্ণনা করেছেন শ্রীমা৷ ঠাকুর কখনো নিরানন্দে থাকতেন না৷ যিনি আনন্দস্বরূপ তিনি কি করে নিরানন্দে থাকতে পারেন৷ তঁার আনন্দেই জগতের সব আনন্দ! যে কোন পরিস্থিতিতেই ঠাকুর নিজেকে মানিয়ে

নিয়ে আনন্দে থাকতেন৷ দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন ঠাকুরের েপট খারাপ হতো, বলতেন, শরীরে শুধু মল রয়েছে— সারাক্ষণ মলই বের হচ্ছে৷ তাই শরীরে ঘেন্না ধরে েগল৷ যে শরীরকে আমরা এত আপন ভে​েব তার যত্ন আত্তি করি, েসই শরীরের প্রকৃত স্বরূপ অনুভব করে জগতের সামনে তুলে ধরলেন৷ কামারপুকুরে থাকাকালীন সকাল থেকে উঠে ‘এই শাক খাব’ ইত্যাদি বলতে থাকতেন৷ আর শ্রীমা ও লক্ষ্মীিদদির মা মিলে, তাই রান্না করে রাখতেন৷ কয়েক দিন পরে তা থেকেও তাঁর মন উঠে গেল৷ বললেন, ‘তোমরা যা রান্না করবে, তাই খাব৷’ মনকে যেভাবে চালনা করবে সে েসভাবেই চলবে৷ মনকে নিেজর অধীনে রাখতে হয়৷ মনের অধীনতা স্বীকার করলেই যত কষ্ট৷ শরীরের অনিত্যতা সম্পর্কে বোধে েবাধ করে দৃঢ় মনে ভগবােনর স্মরণ-মনন করলে ভগবানলাভ সম্ভব হয়৷ তাই অমূল্য মনের সঙ্গে প্রভুত্বের সম্পর্ক তৈির করে মনকে বশে এনে, তাকে সৎকােজ লাগাতে হয়৷ তখনই েসই জীবন হয়ে ওঠে প্রণম্য৷

০৯৭

০৯৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঞ্চাশ “আমি—ছবিতে কি ঠাকুর আছেন? মা—আছেন না? ছায়া কায়া সমান। ছবি ত�ো তাঁর ছায়া। আমি—সব ছবিতেই তিনি আছেন? মা—হাঁ, ডাকতে ডাকতে ছবিতে তাঁর আবির্ভাব হয়। স্থানটি একটি পীঠ হয়। যেমন এই জায়গায় (উদ্বোধনের উত্তরদিকে মাঠ দেখাইয়া) কেউ তাঁর পূজা দিলে। ঐটি তাঁর একটি স্থান হল�ো। আমি—তা, ও সব স্থানের সঙ্গে ঐ সব ভাল স্মৃতি জড়িত আছে বলে অমন মনে হয়। মা—তা নয়, ও স্থানটিতে তাঁর দৃষ্টি থাকে। আমি—আচ্ছা, ঠাকুরকে যে-সব ভ�োগ দাও তা কি ঠাকুর খান? মা—হাঁ, খান। আমি—কই, ক�োন চিহ্ন দেখি না কেন? মা—তাঁর চ�োখ থেকে একটি জ্যোতিঃ বার হয়ে সব জিনিস চুষে দেখে। তাঁর অমৃত—স্পর্শে সেটি আবার পরিপূর্ণ হয়, তাই কমে না।” ০৯৯

—(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ১৯৪-১৯৫) ‘ছায়া আর কায়া সমান’—শ্রীঠাকুরের ছবিেত তঁার উপস্থিতি আছে কি না এরকম প্রশ্ন ভক্তের মনে উঠেছে৷ শ্রীমা এর সঠিক উত্তরটি দিয়ে ভক্তের সংশয় নিরসন করেছেন৷ শুধু তাই নয়, েযখানে ঠাকুর একবার বসেন, সেিট তার স্থানে পরিবর্তিত হয়ে যায়, অন্তত সেস্থান ঠাকুরের নজরে থাকে৷ ঠাকুর সর্বত্র রয়েছেন—ভক্তের মনোবাসনা পূরণ করার জন্য তিনি এই রূপ লীলাখেলা করেন মাত্র৷ আবারও প্রশ্ন ঠাকুরকে যে ভোগপ্রদান করা হয়, তা কি তিনি গ্রহণ করেন? শ্রীমা বলেছেন, ঠাকুরকে যে যা ভক্তিভরে নিবেদন করেন, তিনি তা গ্রহণ করেন৷ তাঁর েচাখ থেকে একটি েজ্যাতিঃ বের হয়ে সব সার অংশ গ্রহণ করে তা অমৃতে পরিবর্তিত করে দেন৷ তাই পরিমাণে কমে না৷ তাই প্রসাদের এত মহিমা! শুধু খাওয়া আর প্রসাদ ধারণ করার মধ্যে পার্থক্য অনেক৷ হোটেলে উদর পূর্তির জন্য খাওয়া হয়, আর মন্দিেরর প্রসাদ ধারণ করে শরীর মনের পরিতৃপ্তি হয়৷ মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতিও হয়৷ মন শুদ্ধ হয়, দেহ পবিত্র হয়৷ েসই েদহমনের সাহায্যে ভগবানের আরাধনা করা হয়৷ ১০০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একান্ন “ভাঙতে সব্বাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু তাকে ভাল করতে পারে কজনে? দুর্বলতা ত�ো মানুষের আছেই।... আমি—শরৎ মহারাজ বললেন, “একা থাকা উন্নত মন হলে সম্ভব, নতুবা যার দ�োষী মন, তার আরও অধ�োগতি হয় ওতে।” মা—কি ভয়? ঠাকুর রক্ষা করবেন। কত সাধু একা থাকে না? আমি—হৃদয় মুখুজ্যেও শেষটায় ঠাকুরের সঙ্গছাড়া হয়েছিল। মা—তা ভাল জিনিসটি কি কেউ চিরদিন ভ�োগ করতে পায়? আমি—তিনি ঠাকুরকে অনেক কষ্টও নাকি দিতেন, গালমন্দ করতেন। মা—যে অত সেবা করে পালন করেছে, সে একটু মন্দ বলবে না? যে যত্ন করে সে অমন বলে থাকে। আমি—ইনিও ত�োমায় এত সেবা করলেন, শেষে এই হল�ো!

মা—তা শাসন না থাকলে চলবে কেন? ভাল হবে কি করে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, কথা, পৃঃ ১৯৯)

১০১

১০২

জগতে মন্দ কাজ করা সহজ, ভাল কাজ করা কঠিন৷ ঠাকুর মায়ের আবির্ভাবে সমাজে পরিবর্তন শুরু হয়েছে৷ একভক্তের মানসিক পরিবর্তন নিয়ে অন্য ভক্তের জিজ্ঞাসা—সবাই কি এভাবে ভে​েঙ যাবে? শ্রীমায়ের জবাব, তা কেন? নিন্দা ঠাট্টায় হতোদ্যম করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কাউকে ভাল করতে পারে কজন? যে ভাল আছে তার জন্য িচন্তা নেই, কিন্তু যে মন্দ তাকে কি করে ভাল করা যায়, তাই করণীয়৷ যে সাধু একা থাকবে—তােক ঠাকুর রক্ষা করবেন৷ হৃদয় ঠাকুরের েযমন সেবা করেছে, েতমনি কষ্টও দিয়েছে৷ তাই তার ফলও পেয়েছে৷ ভাল কােজ ভাল ফল, মন্দ কাজে মন্দ৷ ঠাকুর তবুও হৃদয়কে কখনো মন থেকে দূরে সরিয়ে দেন নি৷ মা কালীই প্রয়োজনে সব ব্যবস্থা করেন, তার সন্তানের জন্য৷ দক্ষিণেশ্বর থেকে বিতাড়িত হয়েছে হৃদয়রাম, পরে িশহড় থেকে ঠাকুেরর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে৷ প্রধান ফটকের কাছে ঠাকুরের দর্শন পে​েয় েসখােনই দণ্ডবৎ প্রণত হয়ে​েছ৷

“আমি বললুম, ‘সাদা চ�োখে কে কবে দেখেছে? তবে চ�োখ বুজে দেখতে পারে। চ�োখ বুজলেও ছবি মনে পড়ে না?


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বাহান্ন ছেলেমানুষ, হয়ত�ো তাই দেখে ভাবছে ঠাকুর দেখছি। বললুম, ‘তা তুমিও সাধনভজন কর, তাঁকে প্রার্থনা কর, ত�োমারও দর্শন হবে।’ মানুষ আপন মনে জানতে পারে সে কতদূর এগিয়েছে, কতদূর জ্ঞানচৈতন্য হয়েছে। অন্তরে অন্তরে বুঝতে পারে যে কতদূর তার ঈশ্বরলাভ হয়েছে। নতুবা সাদা চ�োখে কে দেখছে? ‘উদ্বোধনে’ ধমক খাইয়া ভক্তটি বাগবাজারে গঙ্গার ধারে পড়িয়া থাকিত। কখন�ো বা উদ্বোধনের র�োয়াকে বসিয়া থাকিত। আসিলে দুপুরে র�োয়াকে বসিয়াই দুটি খাইয়া যাইত। এইভাবে কিছুদিন গত হইলে একদিন তাহাকে নানাপ্রকারে বুঝাইয়া রাজি করাইয়া শ্রীশ্রীমায়ের অনুমতিক্রমে (উদ্বোধনে) তাঁহার নিকট লইয়া যাওয়া হইল। মা তাহাকে বুঝাইতে লাগিলেন, “ঠাকুর বলতেন, ‘যারা আমাকে ডাকবে তাদের জন্য আমাকে অন্তিমে দাঁড়াতে হবে।’ এটি তাঁর নিজ মুখের কথা। তুমি আমার ছেলে, ত�োমার ভয় কি? তুমি কেন অমন পাগল হয়ে চলবে? এতে যে তাঁর দুর্নাম হবে! ল�োকে বলবে, ‘তাঁর ভক্ত পাগল হয়েছে।’” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০১)

সাধন ভজন করলেও ঈশ্বরকে সাদা চোখে দেখা যায় না৷ কিন্তু েকান এক ভক্ত ছেলে এরকম চাইলে লোকে তাকে পাগল বলে৷ ভক্তটি উদ্বোধনে ধমক খেয়ে গঙ্গার ধারে পড়ে থাকত বা উদ্বোধনের রোয়ােক বসে থাকত৷ এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তাকে শ্রীমায়ের কাছে নিয়ে অাসা হলে, শ্রীমা তােক বুঝিয়ে বললেন যে, ঠাকুর বলেন, যারা তাকে ডাকবে অন্তিেম তিনি তাদের নিয়ে যাবেন৷ অারও বললেন েয, ‘তুমি আমার ছেলে, এমন করলে লোকে যে েতামায় পাগল বলবে এবং ঠাকুেররই দুর্নাম হবে৷’ তাঁর নাম করে পাগল হওয়া কি ঠিক? ঠাকুরের নাম করলে মুক্তি হয়, পাগল হয় না৷ যার অনুভূতি হয় েস চুপ করে বসে থাকে৷ স্বাভাবিক মানুষ যেমন েতমনটিই থাকা উচিত৷ এমন কিছু আচরণ প্রকাশ করা উচিত নয়, যাতে করে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে৷

১০৩

১০৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তিপান্ন “আমি—মা, ঠাকুর বলতেন যে ঈশ্বরক�োটী নির্বাণের (নির্বিকল্প সমাধির) পরও ফেরে, আর কেউ পারে না, এর মানে কি? মা—ঈশ্বরক�োটী নির্বাণের পরও মনটি গুছিয়ে আনতে পারে। আমি—যে মন লীন হয়ে গেল, সে মন কি করে ফিরে আসে? একঘটি জল পুকুরে ফেলে দিলে কি করে সেই জলটুকুই বেছে আনবে? মা—সব্বাই পারে না। যাঁরা পরমহংস তাঁরা পারেন! হাঁস, জল দুধ একত্র করে দাও, দুধটুকু বেছে খাবে। আমি—সবাই কি নির্বাসনা হতে পারে? মা—তা পারলে ত�ো সৃষ্টি ফুরিয়ে যেত। পারে না বলেই ত�ো সৃষ্টি চলছে—পুনঃপুনঃ জন্মাচ্ছে। আমি—যদি গঙ্গায় দেহত্যাগ হয়? মা—বাসনা ফুরুলেই হয়, নইলে কিছুতেই কিছু নয়। বাসনা না ফুরুলে শেষ জন্ম হলেই বা কি হবে?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৩)

বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে জন্মচক্রের এই প্রসঙ্গটি হয়েছে৷ ঈশ্বরকোটি নির্বিকল্প সমাধির পরও ফিের আসতে পারে৷ জীবকোটি তা পাের না৷ উপমা দিচ্ছেন, একঘটি জল পুকুরে ফেলে কি েসই জল অাবার পৃথক করা যায়? পরমহংস পারেন৷ দুধে জলে মিশে থাকলেও দুধটুকু গ্রহণ করেন৷ বাসনা থাকলে মুক্তি হয় না৷ কিন্তু কেন সবাই কি নির্বাসনা হতে পারে না? এ প্রশ্নের উত্তরে কি অপূর্ব জবাব, তাহলে যে সৃষ্টিচক্র চলবে না৷ যদি গঙ্গায় েদহত্যাগ হয়? েসই একই উত্তর, বাসনা না ফুরলে েকান লাভ নেই, মুক্তি তো দূেরর কথা৷ ঘুঁটি একটি দুিটই কাটে, সব কাটে না৷ সে এরকম মুিক্ত এক দুজনেরই হয়, সবার নয়৷ জন্মজন্মান্তর ধরে তপস্যা করলে ভগবানের কৃপা যার প্রতি হবে, সেই মুক্তি পাবে৷ এটা কোন নিয়মের অধীন নয়, অবশ্য তা বলে খামখেয়ািলপনাও নয়৷ আপাতভাবে কোন েকান ঘটনা েদখে তাই মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়৷ যেমন—অজামিলের ঘটনা৷ অনেক পাপকর্ম করেও অন্তিমে নারায়ণের স্মরণ নিেয়ই মুক্ত হয়ে গেল৷ প্রকৃতপক্ষে তার অাগের জন্মে নিশ্চয় অনেক তপস্যা করা ছিল বলেই নারায়ণের নাম-স্মরণেই মুক্ত হয়ে গেলেন৷

১০৫

১০৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চুয়ান্ন “আমি—আচ্ছা, মা, কেউ চাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না; আবার কেউ চাচ্ছে না, তাকে দিচ্ছেন—এ কথার মানে কি? মা—ঈশ্বর বালকস্বভাব কি না! কেউ চাচ্ছে, তাকে দিচ্ছেন না; আবার কেউ চায় না, তাকে সেধে দিচ্ছেন। হয়ত�ো তার পূর্বজন্মে অনেক এগুন�ো ছিল। তাই তার উপর কৃপা হয়ে গেল। আমি—তাহলে কৃপাতেও বিচার আছে? মা—তা আছে বইকি। যার যেমন কর্ম করা থাকে। কর্ম শেষ হলেই ভগবান-দর্শন হয়। সেটি শেষ জন্ম। আমি—মা, জ্ঞানচৈতন্যলাভ করতে হলে সাধন, কর্মক্ষয়, সময়, এসব দরকার মানলুম। কিন্তু তিনি যদি আপন জন হন, তবে কি তিনি ইচ্ছা করলেই দেখা দিতে পারেন না? মা—ঠিক কথা, তবে এ সূক্ষ্মটি তুমি যেমন ধরে বসেছ তেমনটি আর কে ধরে বসেছে? সব্বাই ওটা একটা করতে হয় তাই করে যাচ্ছে; ঈশ্বরকে চায় কজনে?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৫)

ঈশ্বর বালকস্বভাব৷ তিনি কেউ চাইলেও কিছু দিেচ্ছন না, আবার কেউ না চাইলেও তােক েজার করে সব দিেয় দিচ্ছেন; বালকেরা সাধারণতঃ যা করে থাকে৷ বাস্তবের দৃষ্টান্তে ভগবানের স্বভাব বোঝানো হয়েছে৷ আসলে পূর্ব জন্মে শুভ কর্ম করা থাকলে, তার ফল এ জন্মে পাওয়া যায়৷ েযমন ব্যঙ্কে টাকা জমা থাকলে তবেই তুলতে পারে, না থাকলে েতালা যায় না৷ শুভকর্মে শুভ ফল, অশুভকর্মে অশুভ ফল কিনা৷ যেমন েযমন কর্ম জমা থাকবে, তেমন েতমন ফল পাবে৷ কি সুন্দর বিচার৷ তাই েচষ্টা করতে হয় শুভকর্মের পরিমাণ বাড়াতে, আর অশুভ কর্ম একেবারে না করতে৷ প্রশ্ন হচ্ছে—ঈশ্বরের কৃপাদানেও কি বিচার আছে? শ্রীমা তা সমর্থন করায় আবার প্রশ্ন, অাপনজন হলে? উত্তর—এই সূক্ষ্ম তত্ত্বটি কজন বুঝতে পারে? কজনা ঈশ্বরকে স্বরূপে চায়? যারা চায়, তারা পায় বৈকি! চাওয়ার মতো চাইলে, ডাকার মতো ডাকলে, তিনি সাড়া বা েদখা না দিয়ে পারেন না৷ সূক্ষ্ম দর্শন কখনোই বিচােরর দ্বারা সম্ভব নয়৷ ওকালতি কি আর ভগবানের সঙ্গে চলে, না চালাকি দ্বারা মহৎ কাজ সম্ভব হয়?

১০৭

১০৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঞ্চান্ন “যদুর মা বলে একটি ঝি কিছুদিন ছিল। এক বুড়ি আসত, পূর্বে অসৎ ছিল। এখন বুড়�ো হয়েছে, হরিনাম করে। একাটি একাটি; তবু ও আসছে, ওর সঙ্গে কথা কইতুম। একদিন ঠাকুর দেখে বললেন, ‘ওটাকে এখানে কেন?’ আমি বললুম, ‘ও এখন ভাল কথাই ত�ো কয়, হরিকথা কয়, তাতে দ�োষ কি?’ মানুষের ত�ো আর মনে সব সময় পূর্বভাব থাকে না। তিনি বললেন, ‘ছি ছি! বেশ্যা—ওর সঙ্গে কি কথা? শত হ�োক, রাম রাম!’ পাছে কুবুদ্ধি শিখায় এই ভয়ে তিনি ওসব ল�োকেদের সঙ্গে কথাটি পর্যন্ত কইতে নিষেধ করতেন। এত করে আমাকে রক্ষা করতেন। “কামারপুকুরে একজন তাঁকে দেখতে এসেছিল। ল�োকটা ভাল নয়। সে চলে যাবার পর ঠাকুর বললেন, ‘ওরে, দে, দে, ওখানটার এক ঝ�োড়া মাটি ফেলে দে।’ কেউ ফেলতে না যাওয়ায় নিজেই ক�োদালটা নিয়ে ঠনঠন করে খানিকটা মাটি ফেলে দিয়ে তবে ছাড়লেন। বললেন, ‘ওরা, যেখানে বসে, মাটিসুদ্ধ অশুদ্ধ হয়।’” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৭) নিজ পত্নীকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ১০৯

স্থাপন করলেন ঠাকুর৷ আগে চরিত্র ভাল ছিল না, কিন্তু এখন হরিকথা অর্থাৎ ভগবানের নাম করে, এমন এক বৃদ্ধার সঙ্গে শ্রীমা কথাবার্তা বলতেন৷ কিন্তু ঠাকুর শ্রীমাকে নিষেধ করছেন তার সঙ্গে মেলামেশা করতে৷ প্রত্যুত্তরে শ্রীমা বৃদ্ধার পক্ষ অবলম্বন করলে ঠাকুর ‘ছি, ছি’ করে উঠেছেন৷ অনেকের মনে হতে পারে ভগবানই যদি এমন নিঠুর হন, তাহলে পাপী তাপী মানুষের কি কোন গতি নেই? আছে ৈব কি! তঁার একান্ত শরণাগত হয়ে প্রার্থনা করলে, ভগবান সময় হলে যা করার তা করবেন৷ তা বলে ‘মুিড় মুড়কির এক দর’ হবে না৷ কামারপুকুের ঠাকুরকে দেখতে একজন লোক এসেছিল৷ তার চরিত্র ভাল ছিল না৷ সে চলে যাবার পরে তিনি েসখােন খািনকটা মাটি ফেলতে বলেন৷ তা কেউ না করাতে ঠাকুর নিজেই খানিকটা মাটি ফেলে তবে স্বস্তি পান৷ বলেন, ওরা যেখানে বসে, সেখানকার মাটিও অশুদ্ধ হয়ে যায়৷ এমনই সর্বদ্রষ্টা ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ৷ শ্রীমােক তিনি সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কি প্রযত্নই না করেছেন৷ তঁার মহতী প্রয়ােসই সৃষ্ট জগজ্জননী মা সারদা৷ ১১০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছাপান্ন “আমি—আর, যে ভক্তের ভিড় সমস্ত দিন! ত�োমার আর একটুও বিশ্রাম নেই। মা—আমি ত�ো ঠাকুরকে দিনরাতই বলি, ‘ঠাকুর, এ সব কমিয়ে দাও, একটু বিশ্রাম পেতে দাও।’ তা হয় কই? যে কদিন আছি এমনি হবে। এখন সব চারদিকে প্রচার হয়ে পড়েছে কি না, তাই এত ল�োক! ব্যাঙ্গাল�োরে—বাপরে কত ল�োক! পথে রেল থেকে নামতে সব পুষ্প-বৃষ্টি হতে লাগল। এত উঁচু হয়ে গেল রাস্তা। ঠাকুরেরও শেষটায় কত ল�োক। আমি ত�ো এত বলি, ‘কুলগুরুর কাছে মন্ত্র নাও, তারা প্রত্যাশা করে। আমার ত�ো কিছু প্রত্যাশা নেই।’ তা ছাড়ে না, কাঁদে। দেখে দয়া হয়। আর আমারও শেষ হয়ে এল। এখন যে কদিন আছি, এমনি হবেই।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২০৯) অবতার বা অবতারসঙ্গিনীকে সাক্ষাৎ দর্শনের সুেযাগ পেলে ভক্তকুল কি আর দীক্ষামন্ত্র না নিয়ে ছাড়ে? তাই প্রায় সারাটা দিন ভক্তের ভিড় লেগেই থাকে৷ শ্রীমা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, এই ভিড় কমিয়ে দেবার জন্য যাতে করে একটু বিশ্রাম পেতে পারেন৷ কিন্তু তা সম্ভব হয় নি৷

বাঙ্গালোরেও সেই ভক্তের ভিড়৷ ভাষা জানা নেই, তাতেও েকান অসুবিধা হয় নি৷ েসখানে রেল থেকে নামতে কত পুষ্প-বৃষ্টি হতে লাগল৷ ভক্তির আতিশয্যে শ্রীমায়ের কষ্ট হলেও তা স্বীকার করে নিয়েছেন৷ বলেছেন, ভক্তেরা কাঁদে, েদখে দয়া হয়৷ এই দয়া পেলেই হয়ে েগল৷ ভগবতীর দয়াতে পার হয়ে যােব সাধারণ মানুষ৷ কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিতে বললেও কেউ শোনে না৷ কুলগুরুরা প্রত্যাশা করলেও শ্রীমা কিছু প্রত্যাশা করেন না৷ তাও ভক্তেরা শ্রীমায়েরই কৃপা প্রার্থনা করে৷ এমনই দেবী মহিমায় মুগ্ধ হয়ে পড়ে মানুষ৷ ঠাকুেররও শেষ সময়ে এমনই অবস্থা হয়েছিল৷ প্রচার হতে শুরু হলে তাকে েরাধ করা কষ্টকর৷ ভগবানের অশেষ করুণায় মানুষের মনে ভগবদ্ ভক্তির স্ফূরণ হতে থাকে৷ তাদের হৃৎমাঝারে সহস্রদল পদ্মের প্রস্ফূটিত হওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়৷ তখন সামান্য মাত্র স্পর্শের অপেক্ষা থাকে৷ বীজমন্ত্র রূপ ‘মহামন্ত্র’ লাভের অাশায় ব্যাকুল প্রাণের আর্ত্তি দেখা যায়৷ যথাসময়ে শ্রীমায়ের দর্শন তার বাস্তবে রূপ পায়৷ একটুমাত্র স্পর্শেই ভাবের উদ্গীরণ শুরু হয়ে যায়৷

১১১

১১২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতান্ন “আমি—মা, এইটিই কেবল আমার মনে জাগে—ঠাকুরের কেন দেখা পাই না? তিনি যখন আপনার জন, আর ইচ্ছা করলেই দেখা দিতে পারেন, তখন কেন তিনি দেখা দেন না? মা—তাই ত�ো, এত দুঃখকষ্টেও যে কেন তিনি দেখা দেন না, কে জানে? রামের মার (বলরামবাবুর স্ত্রী) অসুখ হয়েছিল। ঠাকুর আমায় বললেন, ‘যাও, দেখে এসগে।’ আমি বললুম, ‘যাব কিসে? গাড়ি টাড়ি নেই।’ ঠাকুর বললেন, ‘আমার বলরামের সংসার ভেসে যাচ্ছে আর তুমি যাবে না? হেঁটে যাবে। হেঁটে যাও।’ শেষে পালকি পাওয়া গেল। দক্ষিণেশ্বর থেকে আসলুম। দুবার এসেছিলুম। আর একবার—তখন আমি শ্যামপুকুরে—রাত্রে হেঁটে রামের মার অসুখ দেখতে আসলুম। দেখ, সেই বলরামের প�ৌত্র কি সময়ে (নিতাইবাবুর মার শ্রাদ্ধদিনে) মারা গেল। একদিনও কি আগ পাছ হতে নেই? তিনি যদি এ বিপদে না দেখবেন, না দেখা দেবেন, তবে মানুষ যাবে ক�োথা?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২১৫) ঠাকুর ভক্ত পরিবার নিয়ে সংসারলীলা করে​েছন৷ বলরাম

বসুর স্ত্রীর অসুখ শুনে তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য শ্রীমাকে নির্দেশ দিয়েছেন৷ কিেস করে যােব, তা জানতে চাওয়ায়, পায়ে হেঁটেও যেন যায়৷ অবশ্য পালকি পাওয়া গিয়েছিল৷ বলরামের সংসার ভেসে যােব এই ভীতিতে ঠাকুরের কি উদ্বেগ! দক্ষিণেশ্বর থেকে বলরামবাবুর বাড়ি এসে দেখে গেলে তবেই ঠাকুর শান্তি পেয়েছেন৷ আরও একবার শ্যামপুকুরে থাকাকালীন পায়ে হেঁটে বলরামবাবুর বািড় এসে অসুস্থা বলরামবাবুর স্ত্রীকে দেখে গে​েছন৷ এ হেন ভালবাসা ছিল ভক্ত পরিবারের জন্য৷ ধন্য বলরাম! ধন্য বলরাম! এভাবে বললেও কম বলা হবে৷ অবশ্য বলরােমর পরিবার যে সব-এক সুরে বাঁধা৷ চাকর বাকর থে​েক শুরু করে মনিব পর্যন্ত, ভগবােনর না নাম নিয়ে জলগ্রহণ করত না৷ তাই ঠাকুর ভক্ত বলরামের অন্নকে পবিত্র জ্ঞান করতেন৷ একশত বারের েবশি তিনি বলরাম ভবনে এসেছেন৷ েসই ‘বলরাম ভবন’ বর্তমান ‘বলরাম মন্দির’-এ পরিবর্তিত৷ বলরাম ভবনকে ঠাকুর তাঁর কলকাতার ‘বৈঠকখানা’ করে লীলাভিনয় করে গিেয়ছেন৷

১১৩

১১৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটান্ন “মা—যতক্ষণ ‘আমি’ রয়েছে ততক্ষণ বাসনা ত�ো থাকবেই। ওসব বাসনায় ত�োমাদের কিছু হবে না। তিনিই রক্ষা করবেন। যে তাঁর শরণাগত, যে সব ছেড়ে তাঁর আশ্রয় নিয়েছে, যে ভাল হতে চায়, তাকে তিনি যদি রক্ষা না করেন, সে ত�ো তাঁরই মহাপাপ। তাঁর উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। তিনি ভাল করতে হয় করুন, ড�োবাতে হয় ড�োবান। তবে ভাল কাজটি করে যেতে হয় আর তাও তিনি যেমন শক্তি দেন। আমি—আমার কি সেই নির্ভর আছে? হয়ত�ো খানিকটা নির্ভর আসে, আবার তা চলে যায়। তিনি যদি নিজে রক্ষা না করেন ত�ো উপায় কি? মনে ভাবি, এখন মা, তুমি আছ, আপদ হ�োক, বিপদ হ�োক, এসে ত�োমার কাছে বলি, ত�োমার মুখ চেয়ে শান্তি পাই। এর পর কে রক্ষা করবে? তুমি যদি ফিরে চাও, তবে ত�ো হয়? মা—ভয় কি বাবা? ত�োমার ক�োন ভয় নেই। ত�োমাদের সংসার, পরিবার, ছেলেপুলে—এসব ত�ো কিছু হবে না, ত�োমাদের ভয় কি? আর এর মধ্যে, আমি থাকতেই ত�োমরা তৈরি হয়ে যাবে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২১৯)

ভগবানের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করলে, তিনি ইহকাল পরকালের সব ভার নিজে তুলে নেন৷ তঁাকে আশ্রয় করে থাকলে তিনি তাকে রক্ষা না করলে যে তাঁরই মহাপাপ হয় অর্থাৎ তিনি রক্ষা করবেনই৷ তবে তাঁর উপর নির্ভর করে ভাল কাজটি করে যেতে হয় আর তাও তিনি যেমন শক্তি দেন। তঁার উপর নির্ভরতা আসে আবার কখনো কখনো বা চলেও যায়৷ তখন কি হবে? শ্রীমা অভয় দিচ্ছেন—ঠাকুরের ছেলেদের কোন ভয় নেই৷ একবার এই নির্ভরতা ৈতরী হলে তা আর যাবার নয়৷ ঠাকুরকে একবার জীবনের ধ্রুবতারা হিসাবে নির্বাচন করলে আর কোন কিছুই তাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে না৷ লক্ষ্য স্থির হয়েছে, চলা শুরু, কিন্তু মাঝে মাঝে েহাঁচট খাচ্ছে৷ তাতেও পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না৷ কারণ একবার ঠাকুর কারও হাত ধরলে ত্রিজগতে কার সাধ্য নেই তাঁর সন্তােনর ক্ষতি করে! তিনি জাত সাপ, ধরেছে মানে মরেছে; ধোঁড়া সাপ নয় যে কষ্ট পেতে হবে৷ জীবনসংগ্রাম যতই কঠিন হোক, ঠাকুর সাথে অাছেন, হবে জয়৷ জয় অবশ্যম্ভাবী৷

১১৫

১১৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ঊনষাট “কর্মফল ভুগতে হবেই। তবে ঈশ্বরের নাম করলে যেখানে ফাল সেঁধুত, সেখানে ছুঁচ ফুটবে। জপ তপ করলে কর্ম অনেকটা খণ্ডন হয়। যেমন সুরথ রাজা লক্ষ বলি দিয়ে দেবীর আরাধনা করেছিল বলে লক্ষ পাঁঠায় মিলে তাঁকে এক ক�োপে কাটলে। তার আর পৃথক লক্ষ বার জন্ম নিতে হল�ো না। দেবীর আরাধনা করেছিল কিনা। ভগবানের নামে কমে যায়।” আমি—তাহলে কর্মের প্রাধান্যেই ত�ো জগৎ চলছে। তবে আর ভগবান মানা কেন? ব�ৌদ্ধেরাও কর্ম মানে, ঈশ্বর মানে না। মা—তবে কি কালী, কৃষ্ণ, দুর্গা, এসব নেই বলতে চাও? আমি—জপতপের দ্বারা খণ্ডন হয়? মা—তা হবে না? ভাল কাজটি করা ভাল। ভালটি করলে ভাল থাকে, মন্দটি করলে কষ্ট পেতে হয়।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২২১) কর্মের ফল ভোগ করতেই হবে—জগন্নিয়ন্ত্রার নিয়ম৷ তবে ইতর বিশেষ হয়৷ জপ তপ করলে কর্মের কিছুটা খণ্ডন হয়৷ শ্রীমা বলেছেন, যেখােন ফাল সেঁধুত, সেখানে ছুঁচ ফুটে

ফলভোগ হয়ে যায়৷ সুরথ রাজার প্রসঙ্গ উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ ভগবানের নােম এমনই হয়৷ লক্ষ বলির জন্য লক্ষ বার জন্ম নিতে হলো না৷ লক্ষ পঁাঠায় মিেল তঁাকে এক কোেপ কাটলো অর্থাৎ এক জন্মে কর্মফল শেষ৷ কর্মের প্রাধ্যন্যেই জগত চলছে৷ তাই ব�ৌদ্ধেরা কর্ম মানে, ঈশ্বর মানে না৷ তাহলে প্রশ্ন আসে—ভগবান কি নেই? কিন্তু শ্রীমা উত্তরে বলেছেন, কালী, কৃষ্ণ, দুর্গা সবাই আছেন৷ সৃষ্টি, স্থি​িত, প্রলয় বা ধ্বংস তাঁদের নিয়মেই চলে আসছে৷ তবে ভাল কর্মটি করে যেতে হয় আর জপতপের অভ্যাসও করতে হয়৷ জপতপ করলে অর্থাৎ ভগবানের স্মরণ-মনন করলে মনের ময়লা পরিস্কার হয়৷ চিত্ত স্বচ্ছ হলে তাতে প্রতিবিম্ব উজ্জ্বল হবে৷ ভাল কথা বললে যেমন ভাল লাগে, তেমনি মনের কলুষতায় কষ্ট বৃদ্ধি হতে থাকে৷ সুন্দরের জয় জয় কার যেমন সর্বত্র, তেমনিভােবই ভাল কর্মটিও সর্বত্র ভাল ফলই প্রদান করে থাকে৷

১১৭

১১৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ষাট “আমি—বিশ্বনাথকে র�োজ সব ল�োকে ছোঁয়, সেজন্য সন্ধ্যার পর অভিষেক হয়ে তবে আরতি ও ভ�োগ হয়। মা—পাণ্ডাগুল�ো টাকার জন্য ওরূপ ছুঁতে দেয়। কেন ছুঁতে দেওয়া? দূর থেকে দর্শন করলেই ত�ো হয়। যত ল�োকের পাপ এসে লাগে। কত অসচ্চরিত্র নানারকমের ল�োক সব ছোঁয়। “এক একটা ল�োক এমন আছে যে ছুঁলে সব শরীর গরম হয়, জ্বালা করে। তাই হাত পা ধুয়ে ফেলতে হয়। এখানে তবু ল�োকের ভিড় কলকাতার চেয়ে কম।” আমি—এখানে যে মহারাজদের অনুমতি নিয়ে এলে তবে দর্শন হয়—ভিড় কমাবার জন্য এই ব্যবস্থা করেছেন। মা—হাঁ, কে এত সাত জায়গায় দরবার দিয়ে আসতে চায়?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৩-২৩৪) েজ্যাতির্লিঙ্গ বাবা বিশ্বনাথকে পাপী তাপী স্পর্শ করে বলে অভিষেক করে আরতি ও ভোগ হয়৷ শ্রীমা পর্যন্ত বলেছেন, পাণ্ডাগুেলা টাকার জন্য অসচ্চরিত্র নানারকমের

লোককেও স্পর্শ করায় বলে এই অবস্থা৷ দূর থেকে দর্শন করলেই তো হয়৷ পাপীদের স্পর্শে কেমন কষ্ট হয়, তা শ্রীমা জানেন, তাদের ছেঁায়াতে সর্ব শরীর জ্বালা করতে থাকে, তাই ধুয়ে ফেলতে হয়৷ অপাপবিদ্ধ, পবিত্রতা স্বরূপিণী শ্রীমা এমন কথা বললে সাধারণ মানুষ েকাথায় যাবে? আসলে যাদের মনের মধ্যে অপবিত্রভাব আছে, তাদের কথা বলা হয়েছে৷ আবার অন্যত্র এও বলেছেন— ঠাকুর কি শুধু রসগোল্লা খেতে এসেছিলেন? লোকের পাপ-তাপ গ্রহণ করে তােদর মুক্তির পথ দেখাবেন বলেই না তঁােদর মর্ত্যে অবতরণ৷ নিজে ধর্মাচরণে অপরে িশক্ষা দিয়েছেন৷ ঠাকুর যাদেরকে সহ্যকে করতে পারতেন না— শ্রীমাই তো আবার তাদের সব ভার নিয়েছেন৷ সব কিছুই তো করেছেন—দীক্ষা দিয়ে ভক্তের অন্তর্জগতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন৷ অধ্যাত্মপথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন৷ পরম মুক্তির দ্বাের পৌঁছাতেও কৃপণতা প্রকাশ করেন নি৷ জগৎ যে তাঁর আপনার, তাই তাকে নিেজই করে নিতে হয়েছে৷

১১৯

১২০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একষট্টি “সকালে পূজার পর যখন প্রসাদ আনিতে গিয়াছি, পূর্বদিনের কথা মনে করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বল, কাশীতে মলে মুক্তি হয় কি না, কি দেখলে?” মা—শাস্ত্রাদিতে আছে, আর এত ল�োক আসছে—মুক্তি হয়। তাঁর শরণাগত যে তার মুক্তি হবে না ত�ো হবে কি? আমি—শরণাগত যে তার ত�ো মুক্তি হবেই। যে শরণাগত নয়, ভক্ত নয়, বিধর্মী—এদের মুক্তি হবে কি না? মা—তাদেরও হবে। কাশী চৈতন্যময় স্থান। এখানে সব জীব চৈতন্যময়—প�োকাটা মাকড়টা পর্যন্ত। ভক্তাভক্ত, বিধর্মী, যে এখানে মরবে—কীটপতঙ্গ পর্যন্ত—তারই মুক্তি হবে। আমি—সত্য বলছ? মা—হাঁ, সত্য বইকি! নইলে আর স্থান মাহাত্ম্য কি?” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৫) কাশীর মাহাত্ম্য কথা বলে শেষ করা যায় না৷ এখানে মৃত্যু হলে মুক্তি অবধারিত৷ কিন্তু কাদের মুক্তি হবে? যাদের বাসনা ক্ষয় হয়ে তত্ত্বজ্ঞান হয়ে​েছ৷ তত্ত্বজ্ঞান মানে ঈশ্বরতত্ত্ব অর্থাৎ ভগবানই সত্য, আর সব মিথ্যা৷ এইটি বোধে বোধ হওয়া৷

শ্রীমা বলেছেন শরণাগত হলে তার তো মুক্তি হবেই৷ কিন্তু কাশী ৈচতন্যময় স্থান৷ এখানে ভক্ত অভক্ত, ধর্মী, বিধর্মী এমন কি কীটপতঙ্গ পর্যন্ত যদি মরে—তারও মুক্তি হবে৷ সন্দেহ হয়েছে ভক্তের মনে, শ্রীমা তা নিরসন করে দিয়েছেন৷ ঠাকুেরর দর্শন হয়েছিল—কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটে বাবা বিশ্বনাথ মৃতের কর্ণে তারকব্রহ্ম নাম দিচ্ছেন আর মা অন্নপূর্ণা কর্মপাশ েছদন করে দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করে দিচ্ছেন৷ এটি কাশীর স্থান মাহাত্ম৷ এখানে জগতের কোন নিয়ম খােট না৷ পুরাকালে রাজা হরিশ্চন্দ্র তাঁর রাজত্ব হারিয়ে কাশীেত এসে বসবাস করেছিলেন৷ পাপী-তাপীর বাবা বিশ্বনাথের দর্শনে পাপক্ষয় হয়৷ মৃত্যুঞ্জয় শিবনামে অমর হতে চাইলে, অন্তিমে চিরবান্ধব করে নিেত হয় এই অবিমুক্তেশ্বর কাশীধামকে৷ অবশ্য সবার জন্য এই ব্যবস্থা হয় না৷ েকবলমাত্র যাদের তত্ত্বজ্ঞান হয়েছে এবং মুক্ত হওয়ার বাসনা হয়েছে, তাদেরই অন্তিমকাল কাশীতে অতিবাহিত হয়৷ নতুবা কাল ৈভরব, যিনি কাশীর পাহারাদার, তিনি ছলে বলে তাকে কাশীর বাইরে বের করে দেন৷

১২১

১২২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বাষট্টি “মা তাঁহার ঘরে শুইয়া শুইয়াই কথা বলিতেছেন। ‘কাশীখণ্ডে’ আছে, কাশীতে মাছ খাওয়া উচিত নয়। সেই প্রসঙ্গ হইতেছিল। আমি—তা মাছ খেলে প্রাণীহত্যা হয় ত�ো। মা—ওসব মানুষের খাদ্য, মানুষ খাবে না ত�ো কি করবে? আমি—খাদ্যের নাম করে প্রাণীকে ব্যথা দেবে? মা—(অন্য কথার পর) তা বিচার করতে গেলে ওতেও হিংসা হয় বইকি—প্রাণী ত�ো? কাশীপুরে ঠাকুরের জন্য শামুকের ঝ�োল ব্যবস্থা হল�ো। ঠাকুর আমাকে করতে বললেন। আমি বললুম, ‘এগুল�ো জীয়ন্ত প্রাণী, ঘাটে দেখি চলে বেড়ায়। আমি এদের মাথা ইট দিয়ে ছেঁচতে পারব না।’ শুনে ঠাকুর বললেন, ‘সেকি! আমি খাব, আমার জন্য করবে।’ তখন র�োখ করে করতে লাগলুম।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৭-২৩৮) অাহার প্রসঙ্গ এসেছে; তাও আবার কাশীতে। কাশীতে মাছ খাওয়া যায় না। শ্রীমাকে সেই কথা বলাতে তিনিও

অসমর্থন করলেন। খাদ্যদ্রব্য যা, তা খাবে না কেন? খাওয়ার জন্যই খাবার। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের অবস্থানের সময় ডাক্তার তাকে গুগলির ঝ�োল খাওয়ার নির্দেশ দেন। শ্রীমাকে তা রান্না করে দিতে হবে। শ্রীমা দেখলেন, সেগুল�ো জলে চরে বেড়াচ্ছে, জীবন্ত, তাদের হত্যা করতে হবে। ঠাকুরকে আমতা-আমতা করে তার অক্ষমতার কথা জানালে ঠাকুর বলেছেন, আমার জন্যও করতে পারবে না? তখন শ্রীমা র�োখ করে তা রান্না করে দেন। মাছ খাওয়ার এইরকম জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে। শুধুমাত্র বললেই হবে না; তা যাতে শাস্ত্রে প্রমাণসিদ্ধ হয় বা মহাপুরুষদের জীবনচর্যার অঙ্গ হয় তাও দেখা দরকার। আমরা সামান্য বুদ্ধিতে তর্কাতর্কি বা মতান্তর করি৷ আসল ফেলে নকল নিয়ে মেতে উঠি এবং লক্ষ্য ভুলে লক্ষ্য স্থানের েগালোক ধাঁধায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। এমনটি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়৷

১২৩

১২৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তেষট্টি “মা—কাশীপুর বাগান তাঁর অন্ত্যলীলার স্থান। কত তপস্যা, ধ্যান, সমাধি! তাঁর মহাসমাধির স্থান—সিদ্ধস্থান। ওখানে ধ্যান করলে সিদ্ধ হয়। “ঠাকুর যদি তাদের (মালিকদের) স্বপ্ন দিয়ে স্থানটি করে নেন তবে হতে পারে। “ঐ কাশীপুরে একদিন নিরঞ্জন-টিরঞ্জন ওরা কাঁচা রস খাবে বলে রস চুরি করতে যাচ্ছে। আমি দেখি কি ঠাকুরও তাদের পিছে-পিছে যাচ্ছেন। পরদিন তাঁকে একথা বলায় তিনি বললেন, ‘ও রেঁধে ত�োমার মাথা গরম!’ “ঢাকায় বিজয় গোঁসাইও দেখেছিল (ঠাকুরকে)—গা টিপে। “তাঁর যাবার পর নরেন এরা বললে, ‘বাড়িটা তিন দিনও থাক, আমরা ভিক্ষে করে খাওয়াব মাকে—সদ্য সদ্য মায়ের মনে কষ্ট।’ রামদত্ত-টত্ত এরা বললে, ‘ত�োদের আর ভিক্ষে করে খাওয়াতে হবে না।’ বাড়ি চুকিয়ে দিলে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৩৯-২৪০) কাশীপুর শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলার স্থান। এখানে ঠাকুরের কত সমাধি হয়েছে; তাই মহা পবিত্র স্থান। এই স্থানে তপস্যা

করলে সিদ্ধি অনিবার্য। ঠাকুরের মহাসমাধির পর এই গৃহী ভক্তেরা বাড়িটি আর রাখার দরকার ব�োধ করল না। শ্রীমা সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। মনের কি নিদারুণ কষ্ট। ত্যাগী ছেলেরা শ্রীমাকে নিয়ে চিন্তিত হলেন। কিন্তু ভগবানের অন্য ইচ্ছায় েসই স্থান আপাতত ত্যাগ করে শ্রীমাকে বিভিন্ন ভক্তের বাড়িতে থাকতে হল। ত্যাগী সন্তানেরা শ্রীমায়ের জন্য একটা স্থায়ী বাসস্থানের চেষ্টা করতে লাগলেন। শুভ কামনা ও ত্যাগীদের ঐকান্তিকতায় সত্যি সত্যি একদিন বাগবাজারে মায়ের বাড়ি তৈরি হলো। কাশীপুরের স্থান মাহাত্ম এই জন্য যে একদিন নিরঞ্জনেরা বালচপলতায় খেজুর রসের অন্বেষণে যায়। তখন ঠাকুর শয্যাগত৷ শ্রীমা দেখলেন হঠাৎ ঠাকুর ছুটে গিয়ে আবার বাইরে থেকে ফিরে আসছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসায় তিনি বললেন, ঐ খেজুর গাছের তলায় একটি গ�োখর�ো সাপ ছিল। তাকে তাড়িয়ে দিয়ে এলাম। একটু রস খেয়ে আনন্দ করবে তার সন্তানেরা; তাই এই ব্যবস্থা। কাশীপুরের এই ত্যাগী সন্তানদের প্রতি ঠাকুরের ভালবাসা ছিল। তাই এই কাশীপুরে অবিস্মণীয়৷

১২৫

১২৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চ�ৌষট্টি “আমি—মা, এই যে স্বামীজী কত ল�োককে মন্ত্র দিয়েছেন, তুমিও কত ল�োককে দিচ্ছ, এ যেন কেউ এলে দুট�ো টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হল�ো, আর মনে রইল না। মা—এত ল�োক আসছে, কটিকে মনে রাখা যায়? আগুন জ্বাললে বাদুলে প�োকা আসে না? সেই রকম। আমি—এই যে মন্ত্র নেয়, কি পায়? এমনি ত�ো বাহ্য দৃষ্টিতে দেখি, ল�োকটি যেমন ছিল তেমনি আছে। মা—মন্ত্রের মধ্য দিয়ে শক্তি যায়। গুরুর শক্তি শিষ্যে যায়, শিষ্যের গুরুতে আসে। তাই ত�ো মন্ত্র দিলে পাপ নিয়ে শরীরে এত ব্যাধি হয়। গুরু হওয়া বড় কঠিন— শিষ্যের পাপ নিতে হয়। শিষ্য পাপ করলে গুরুরও লাগে। ভাল শিষ্য হলে গুরুরও উপকার হয়। কারও বা হঠাৎ উন্নতি হয়, কারও বা ক্রমে হয়। তা যার যেমন সংস্কার। “রাখাল তাই মন্ত্র দিতে চায় না। বলে, ‘মা, মন্ত্র দিলে অমনি শরীর অসুস্থ হয়।’ মন্তরের নামে আমার গায়ে জ্বর আসে!” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪১)

শ্রীমায়ের সঙ্গে দীক্ষা দান নিয়ে কথা হচ্ছে৷ দীক্ষা দিলে গুরুর শক্তি িশষ্যে যায় এবং শিষ্যের শক্তি গুরুতে আসে৷ সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যের পাপও গুরুতে আসে৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে সব িশষ্যকে কি গুরুদেবেরা মনে রাখেন না কি দীক্ষা দিয়েই সম্পর্কের ছেদ হয়ে যায়? বাহ্য দৃষ্টিতে কি পরিবর্তন হয় তােদর? মন্ত্র অন্তঃসলিলা৷ শিষ্য ভাল হলে গুরুরও মঙ্গল হয়, অন্যথায় িশষ্যের পাপাদি গুরুতেও তা বর্তায়৷ দীক্ষান্তে যার যা সংস্কার েস ভাবেই সে এগিয়ে যায়; শুভ সংস্কার থাকলে দ্রুত উন্নতি হয়৷ শিষ্যের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে গুরুর অদৃশ্য শক্তি ক্রিয়াশীল থাকে৷ গুরু সর্বদা িশষ্যের কল্যাণই কামনা করেন৷ বাহ্যত আকারগত কোন পরিবর্তন দেখা না দিলেও আভ্যন্তরিণ পরিবর্তন হয়ে যায়৷ শাস্ত্রে যেমন আছে, দড়ি পুড়ে গেলেও ছাইটি দড়ির আকারেই থাকে, কিন্তু েস দড়ি আর পূর্বের মতো কাজে লাগে না৷ তেমনি দীক্ষিত মানুষের অন্তরের যে পরিবর্তন হয়, তা বাইরে থেকে দেখা না েগলেও, আত্মিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভভাবী৷

১২৭

১২৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁয়ষট্টি “ললিতবাবু—মা, খাওয়া-দাওয়ার কি রকম নিয়ম পালন করা উচিত। মা—আদ্যশ্রাদ্ধের অন্ন খেতে নেই, ভক্তির বড় হানি হয়। বরং অন্য শ্রাদ্ধের অন্ন খাবে, তবু আদ্যশ্রাদ্ধের নয়, ঠাকুর নিষেধ করতেন। আর যা কিছু খাবে, ভগবানকে দিয়ে খাবে, অপ্রসাদী অন্ন খেতে নেই। যেমন অন্ন খাবে তেমন রক্ত হবে। শুদ্ধ অন্ন খেলে শুদ্ধ রক্ত হয়, শুদ্ধ মন হয়, বল হয়। শুদ্ধ মনে শুদ্ধা ভক্তি হয়, প্রেম হয়। ললিতবাবু—মা, আমরা ত�ো গৃহী, আত্মীয় স্বজনের শ্রাদ্ধে কি করব? মা—শ্রাদ্ধে গিয়ে কাজকর্ম দেখবে, খাটবে, যেন তারা কিছু মনে না করতে পারে। কিন্তু সে দিনটা ক�োন রকম করে খাওয়াটা এড়াতে চেষ্টা করবে। নেহাৎ না পারলে শ্রাদ্ধে বিষ্ণু বা দেবতাদিগকে যা নিবেদন হয়, তাই গ্রহণ করবে। প্রসাদী হলে আদ্যশ্রাদ্ধের অন্নও ভক্তেরা খেতে পারে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪৩) শ্রাদ্ধের অন্ন খাওয়া নিয়ে নানা মতবাদ প্রচলিত আছে৷ এ নিয়ে অনেক সমস্যারও উদ্ভব হয়৷ শ্রীমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন ১২৯

করা হলে, তিনি অপূর্বভাবে সুক�ৌশলে ঠাকুেরর কথা টেনে উত্তর প্রদান করেছেন৷ তিনি বলেছেন, শ্রাদ্ধের অন্ন, বিশেষ করে আদ্যশ্রাদ্ধের অন্ন খাবে না৷ তাতে ভক্তিভাবের ক্ষতি হয়৷ তবে এও বলেছেন, এমন সামাজিক পরিস্থিতিতে পড়লে যে, না খেয়ে আসা যাবে না, তখন বিষ্ণু বা অন্য দেবতােদর যে নৈবেদ্য নিেবদিত হয়, েসই প্রসাদ গ্রহণ করা যে​েত পারে৷ তবে যখনই খাবার খাওয়া হোক তা মনে মনে ভগবানকে নিবেদন করে খেলে মন শুদ্ধ হবে, পবিত্র হবে এবং েসই মনে প্রেমের সঞ্চার হবে৷ ললিতবাবুর প্রশ্ন, তারা গৃহী, তাদের আত্মীয়ের শ্রাদ্ধে কি করা উচিত৷ ঐ একই কথা খাটবে, তবে শ্রাদ্ধ বাড়িেত গিয়ে কাজকর্ম করবে, দেখাশুনা করবে েযন তারা কিছু মনে না করে এভােবই মানিয়ে নিেত হবে৷ খাওয়া নিয়ে বেিশ বাড়া বািড় না করে প্রসাদজ্ঞানে তা ধারণ করতে পারলেই সব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়ে যায়৷ পরিবেশ, পরিস্থিতি েদখে চটজলদি িসদ্ধান্ত নিেত পারলে কোন সমস্যা হয় না৷ পরস্পর পরস্পরের ভাব বজায় েরখে চলাই শ্রেয়৷

১৩০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

েছষট্টি “মা—হাঁ, তাই ত�ো। এই যে ছেলেটি ক�োয়ালপাড়ায় মারা গেল, এর কি আর পুনর্জন্ম হবে? এর আর জন্ম হবে না। “কাশীপুরে তাঁর অসুখের সময় তিনি বললেন, ‘এই অসুখ, খাজাঞ্চী-টাজাঞ্চী ল�োকে কেউ কিছু বলবে— প্রায়শ্চিত্ত করলে না। ও রামলাল, তুই দশটা টাকা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যা, মা কালীকে নিবেদন করে বামুন-টামুনদের বিলিয়ে দে।’ “সাধুর ত�ো কর্ম নেই, তাই টাকা ইষ্টকে নিবেদন করে দিয়ে বিতরণ করতে বললেন। মুনি-ঋষিরা বনে থাকতেন। তাঁরা কি চান্দ্রায়ণ করতে পারতেন? তাঁরা ফলমূল নিজ ইষ্টকে নিবেদন করে সব্বাইকে বিতরণ করতেন। তাঁদের ওতেই হয়।” পাগলী মামী—এই আমার মাসি র�োগ নিয়ে মরেছে। তাহলে তারও কি সে র�োগ হয়েছে? মা—ত�োর মাসি মরে জন্ম নেয়নি? সে মরে জন্মও নিয়েছে, সেই র�োগও তার সঙ্গে এসেছে।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৪৭) ১৩১

শ্রীমাকে পুর্নজন্ম নিয়ে িজজ্ঞাসা করা হয়েছে৷ তিনি যে সব ঘটনা ঠাকুরের কাছে থেকে দেখেছেন—তারই নিরিখে জবাবও দিয়েছেন৷ কোয়ালপাড়ায় যে ছেলেটি মারা েগছে, তার পুর্নজন্ম সম্পর্কে শ্রীমা বলেছেন, না, ওর অার জন্ম হবে না৷ যেহেতু অন্তিমে মাতৃদর্শন ও ঠাকুরের নাম নিয়ে মৃত্যু হয়েছে৷ কাশীপুরে ঐ ঠাকুরের অসুখের জন্য ঠাকুর রামলালকে বলেছেন, দশ টাকা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে মা কালীকে নিেবদন করে বামুনদের বিলিয়ে দিেত৷ যেহেতু সাধুর কর্ম নেই, তাই টাকা ইষ্টকে নিবেদন করে বিতরণ করতে হয়৷ প্রায়শ্চিত্তের দরকার হয় না৷ মুনি-ঋষিরা বনে জঙ্গলে বসবাস করতেন, ফলমূল খেতেন৷ তাঁরা চান্দ্রায়ণ করতেন না৷ তাঁরাও ফলমূল নিজ ইষ্টকে নিেবদন করে বিতরণ করতেন৷ কিন্তু পাগলী মামীর মাসি যে েরাগ নিয়ে মরেছে, পরজন্মে কি তারও েস রোগ হয়েছে? এ প্রশ্নে শ্রীমা স্পষ্ট জবাব, েস জন্মেছে এবং েসই েরাগও নিয়ে এসেছে৷ মরণকালে যে নিয়ে যা চিন্তা করতে করতে মরবে, তাই নিয়ে তার পরবর্তী জীবন শুরু হবে৷

১৩২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতষট্টি “সুরেনবাবু—এই ত�ো, মা, সংসারে দশজন নিয়ে বাস। রান্না হতে হয়ত�ো দুজন অগ্রভাগ খেয়ে গেছে। তারপর সেই অন্ন এল! তা নিবেদন করতেও দ্বিধা লাগে। মা—তা সংসারে ওরকম হবেই। আমাদেরও হয়। ধর না, একজন হয়ত�ো র�োগা, তার জন্য আগে একটু উঠিয়ে রাখতে হল�ো। তা খাবার এলে, তিনিই খেতে দিলেন মনে করে তাঁকে স্মরণ করে খাবে। দ�োষ হবে না। সুরেনবাবু—হাঁ, মা, এখানকার এই ভাব দেখেই মনকে প্রব�োধ দিই, আর ভরসা হয়। মা ত�ো সংসারের যন্ত্রণা নিজে দেখছেন, কাজেই দয়া হবে। মা—তা ভয় নেই, বাবা, ঠাকুর আছেন। তিনিই ত�োমাদের ইহকাল পরকাল সব রক্ষা করবেন।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫০) সংসারে খাদ্য গ্রহণে কি ধরণের সমস্যা হয় এবং তার সমাধান কিভাবে হয়ে থাকে, শ্রীমা সেসব স্বচোেখ দে​েখছেন এবং সাধনও করে​েছন৷ ঠাকুরকে নিবেদন করার আগে েসই খাবার বাড়ীর েকউ খেলে কি হবে—এই প্রশ্নে শ্রীমা তঁার নিেজর সংসারের ঘটনা উপমা হিসাবে ব্যবহার করেছেন৷

বাড়ীেত হয়তো েকাউ রোগা মানুষ আছে, তার জন্য কিছুটা উঠিয়ে রাখতে হলো, পরে ঐ খাবার এলে তা ঠাকুরকে স্মরণ করে খাবে৷ ঠাকুরের ভক্ত শ্রীমাকে বলে​েছন এখানে অর্থাৎ শ্রীমায়ের সংসারের ভাব দেখে, নিেজকে সান্ত্বনা দেন, কারণ তিনি নিজগুণে সব ক্ষমা করবেন৷ সংসারের কি যে যন্ত্রণা শ্রীমা তা প্রত্যক্ষ করেছেন৷ তাই শ্রীমা অভয় দিয়েছেন, বাবা, ঠাকুর অাছেন, তিনিই েতামাদের ইহকাল পরকাল রক্ষা করবেন৷ ব্যস, আর কি চাই৷ ঠাকুর রক্ষা করবেন—এই ভরসােতই শান্তিেত বসবাস করা যাবে৷ অন্তিম কাল নিেয় চিন্তা থাকে, তাও শ্রীমা বিশেষভাবে আশ্বাস দিয়েছেন, ঠাকুরকে ধরে সংসার করলে েকান ভয়ের কারণ নেই৷ ঠাকুেরর স্বরূপ বা শ্রীমায়ের স্বরূপ চিন্তনে মননে মনুষ্য জীবনের সার্থকতা আসে৷ মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ভগবানলাভ৷ এই ভগবান ও ভগবতীই তো ঠাকুর-মা৷ তঁাদের ধ্যােন জীবন অতিবাহিত করতে পারলেই ধন্য হয় যায় জীবনধারণ৷ কৃতকৃতার্থ হয় স্বীয় জীবনের মহিমা৷ অন্তিমে ঠাকুর এসে হাত ধরে তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন—এই ভরসােতই আসে শান্তি, পরম শান্তি৷

১৩৩

১৩৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটষট্টি “মধ্যাহ্নে মায়ের ঘরের বারান্দায় আমি ও মুকুন্দ (সাহা) খাইতে বসিয়াছি। মা বড় মামার বারান্দার পূর্বপাশে বসিয়া আছেন, এমন সময় নলিনী ভিজা কাপড়ে আসিয়া বলিল, কাকে তাহার কাপড়ে প্রস্রাব করিয়াছে বলিয়া সে আবার স্নান করিয়া আসিয়াছে। মা—বুড়�ো হতে চললুম, কাকে প্রস্রাব করে, কখন�ো শুনিনি! বহু পাপ, মহাপাপ না হলে কি মন অশুদ্ধ হয়? কৃষ্ণ ব�োসের ব�োনের অমনি শুচিবাই ছিল। ‘টিকিটা ডুবল কি?’—গঙ্গায় নাইতে গিয়ে ডুব দিচ্ছে, আর ল�োকেদের জিজ্ঞাসা করছে। শুচিবাই, মন আর কিছুতেই শুদ্ধ হচ্ছে না। অশুদ্ধ মন অনায়াসে যায় না। আর শুচিবাই যত বাড়াবে তত বাড়বে। সবই যত বাড়াবে তত বাড়বে। আমি—মহাপুরুষকে দেখেছি ভজা প্রভৃতি কুকুরগুল�োকে ঘেঁটে তারপর হয়ত�ো ঠাকুরপূজা করতে গেলেন। যাবার সময় কেউ হাতে জল (তখন গঙ্গাজলই সব কাজে ব্যবহার হত�ো) ঢেলে দিলে, আচমনের মত�ো একটু হাত ধুলেন মাত্র।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫৬)

প্রচণ্ড শুচিবাই গ্রস্ত ছিলেন নলিনীদিদি৷ এ নিয়ে হাস্যাস্পদ হলেও একদিন তিনি শ্রীমাকে ভিজা কাপড়ে এসে বলেছেন, পি​িসমা কাক তার কাপড়ে প্রস্রাব করেছে৷ শ্রীমা অবাক হয়ে বলেছেন, কাক কখনো প্রস্রাব করে, শুনিনি৷ অনেক পাপ বা মহাপাপ না করলে এই শুিচবাই আসে না৷ মহাপাপে মন অশুদ্ধ না হলে এমন হয় না৷ মনোবিজ্ঞানে একে একটি মানসিক রোগ বলা হয়৷ এর চিকিৎসা করালে অবশ্য সারতে পারে৷ শ্রীমা এমনই আরেকটি ঘটনার উপস্থাপনা করেছেন—গঙ্গায় নাইতে গিয়ে টি​িক ডুবলো কি না এমন ভাবনাও হয়! শুিচবাই যত বাড়ােব ততই এটি বাড়তে থাকবে৷ একে বাড়তে দিেত নেই৷ মহাপুরুষ মহারাজ তাঁর কুকুরগুলোেক হাত দিয়ে আদর করে তার পর সামান্য গঙ্গা জল দিয়ে হাত ধুয়েই ঠাকুরপূজা করতে যেতেন৷ এই হচ্ছে স্বাভাবিকতা৷ এত শুচিবাই হলে অর্থাৎ মনের মধ্যে পাপ ঢুকে থাকলে তা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন৷ তাই মনকে পরিষ্কার ও পবিত্র রাখতে হয়৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ভাল, কিন্তু তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ভাল নয়৷

১৩৫

১৩৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনসত্তর “এই সংসার করে এলুম, এই কুড়িগণ্ডা ছেলের বাপ হয়ে এলুম! বলে কি না, ‘ঠাকুরের দেখা কেন পাই না?’ “ঠাকুরের কাছে মেয়েমানুষগুল�ো যেত। বলত, ‘কেন ঈশ্বরে মন হয় না?’ ‘কেন মন স্থির হয় না?’—এই সব। ঠাকুর তাদের বলতেন, ‘আরে, গা থেকে এখনও আঁতুড়-গন্ধ যায়নি। আগে আঁতুড়-গন্ধ ছাড়ুক। এখন কিরে? ক্রমে হবে। এজন্মে এই দেখা হল�ো, পরজন্মে আবার দেখাটেখা হবে, তখন হবে।’ “যখন দেহ থাকে তখন অনায়াসেই দর্শন মেলে। এই এখানে রয়েছি—এলেই দেখা হয়। এখন ঠাকুরকে চাক্ষুষ দেখা কজনের ভাগ্যে হয়? বিজয় গোঁসাই ঢাকায় দেখেছিল—গা টিপে। ঠাকুর বললেন, ‘আত্মাটা যে বেরিয়ে যায়, এ ভাল নয়; দেহ বুঝি এবার বেশিদিন থাকবে না।’ “কার হয়েছে বল না? নরেনের তিনি করে দিয়েছিলেন। শুক, ব্যাস, শিব ত�ো ডেয়�ো-পিঁপড়ে। স্বপ্নে-টপ্নে হয়ত�ো দর্শন হয়। নতুবা তিনি দেহ ধরে দেখা দেবেন, সে বহু ভাগ্যের কথা।” —(স্বামী অরূপানন্দ, পৃঃ ২৫৯)

ঠাকুরের দর্শন নিয়ে কথা হচ্ছে৷ কেন ঠাকুরকে দর্শন পাওয়া যায় না প্রসঙ্গে শ্রীমা বলেছেন, ঠাকুরের কাছে মেয়েমানুষগুলোও যেত, তারা এই কথা ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করত৷ ঠাকুর তােদর বলেছিলেন, আগে শরীর থেকে আঁতুড় গন্ধ যাক৷ তার পরে অর্থাৎ ভোগবাসনা ত্যাগ হলে হবে৷ সংসার করে, বাপ হয়ে বেশ কয়েকটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে৷ তারাও যদি এখনই ঈশ্বর দর্শন চান তো ঠাকুর কি করেন৷ কিন্তু নিরাশ করেন নি৷ বলেছেন, হবে, ধীরে ধীের, এজন্ম েদখাশুনা হলো, পরজন্মে আবার দেখাটেখা হবে৷ সামর্থ্য থাকতে ভগবানের চিন্তা না করে বিষয় বাসনায় ডুবে থেকে মৃত্যু সময়ে েকন ঠাকুর দেখা দিলেন না বলে হা-হুতাশ করলে চলে না৷ আত্মাই সব৷ দেহবুদ্ধি থাকলে হয় না৷ কার হয়েছে? শুকদেব, ব্যাসদেবকেও ডেয়ো-পিঁপড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন৷ বহু ভাগ্যে তঁার দর্শন পাওয়া যায়৷ স্বপ্নে-টপ্নে দর্শন হলেও হতে পারে৷ কিন্তু তাঁর পার্থিব শরীর যাওয়ার পর আবার দেহ ধরে ভক্তকে দর্শন দান করলে তা বহু সাধনার ফসল বলতেই হয়৷

১৩৭

১৩৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সত্তর “একবার পূজার সময় মামাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু কাপড় কিনিবার ভার মা আমার উপর দেন। আমি সব দেশী কাপড় লইয়া যাই। মেয়েরা অধিকাংশই অপছন্দ করিলেন এবং তাঁহাদের নিজেদের পছন্দমত ফরমাস করিতে লাগিলেন। আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, “ওসব ত�ো বিলিতী হবে, ও আবার কি আনব?” শ্রীশ্রীমা একপাশে বসিয়াছিলেন। তিনি একটু হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বাবা, তারাও (বিলাতের ল�োক) ত�ো আমার ছেলে। আমার সকলকে নিয়ে ঘর করতে হয়। আমার কি একর�োখা হলে চলে? ওরা যেমন যেমন বলছে তাই এনে দাও।” পরে দেখিতাম কাহারও জন্য ক�োন বিলাতী দ্রব্য আনাইতে হইলে মা আমাকে না বলিয়া অপরকে দিয়া আনাইতেন। কাহারও ভাবে আঘাত দেওয়া তাঁহার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৩) ‘কারও ভাব নষ্ট করতে নেই’—এবাক্যটি শ্রীমা মেনে চলতেন৷ বিলিতী বস্ত্র কিনতে চাইছেন না স্বদেশী করা ছেলে৷ আর শ্রীমায়ের ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য স্বদেশী কাপড় কিনে নিয়ে এলে তাদের পছন্দ না হওয়াতে তাদের

পছন্দের কথা শুনে বলেছে, ও তো বিলিতী কাপড়৷ শ্রীমা তা শুনেছেন, এবং বলেছেন, ওরাও তো তাঁরই সন্তান৷ জগজ্জননী তার বিশ্বমোহিনী দৃষ্টির প্রসারতা দিয়ে সারা বিশ্বকে নিেজর মনে করতেন৷ েসখানে স্বদেশী বিদেশী বলে কোন ভেদ নেই৷ আর সাধারণ জীব, েস তো এই বিশ্বজননীর সম্যক দৃষ্টির কথা জানেন না৷ তার কাছে বিলিতী মানেই নিজস্ব নয়, তাই পরিত্যজ্য৷ এহেন পরিস্থিতিতে শ্রীমা অপূর্ব ক�ৌশল অবলম্বন করেছেন— বিলিতী দ্রব্য কেনা দরকার হলে অপরকে দিয়ে তা করাতেন৷ কারণ কারও ভাবে আঘাত দেওয়া তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল৷ আপনভাবে বর্ধিত হওয়া সন্তানকে কদর করতেন৷ তার স্বভাবের পরিবর্তন না করে, তার কাজের মোড় ঘুিরয়ে দিেতন শ্রীমা৷ জগতের সবার মঙ্গল হোক— এই ছিল শ্রীমােয়র কামনা৷ একরোখা বা পক্ষপাতিত্ব শ্রীমায়ের জন্য নয়৷ সবাইকে নিয়ে সংসার করতে হয়৷ এই িশক্ষাটি নিতে হয় যে সবার সঙ্গে থেকেও স্বতন্ত্র থাকতে পারা যায়৷ ভগবােনর শ্রীপাদপদ্মে মন রেখে চলার অভ্যাস করলে যে যেখানে েয অবস্থায় থাকুক না েকন, সে আনন্দ ও শান্তির আগার পাবেই পাবে৷

১৩৯

১৪০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একাত্তর “মা বলিলেন, “আহা, শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) আমাকে স�োনার ১০৮টি বেলপাতা দিয়ে রামেশ্বরের পূজা করালে। রামনাদের রাজা, আমি এখানে এসেছি শুনে, তাঁর দেওয়ানকে হুকুম দিলেন, মন্দিরের রত্নাগার খুলে আমাকে দেখাতে; আর যদি আমি ক�োন জিনিস পছন্দ করি, তখনই যেন তা আমাকে উপহার দেওয়া হয়। আমি আর কি বলব? কিছু ঠিক করতে না পেরে বললাম, ‘আমার আর কি প্রয়�োজন? আমাদের যা কিছু দরকার সব শশীই ব্যবস্থা করছে।’ আবার তারা ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে বললাম, ‘আচ্ছা, রাধুর যদি কিছু দরকার হয়, নেবে এখন।’ রাধুকে বললাম, ‘দেখ, ত�োর যদি কিছু দরকার হয়, নিতে পারিস।’ তারপর যখন হীরা-জহরতের জিনিস সব দেখছি তখন কেবলই আমার বুক দুরদুর করছে। ঠাকুরের কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করছি, ‘ঠাকুর, রাধুর যেন ক�োন বাসনা না জাগে।’ তা রাধু বললে, ‘এ আবার কি নেব? ও সব আমার চাই না। আমার লেখবার পেন্সিলটা হারিয়ে ফেলেছি, একটা পেন্সিল কিনিয়ে দাও।’ আমি এ কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাইরে এসে রাস্তায় দ�োকান থেকে দু পয়সার একটা পেন্সিল কিনিয়ে দিলাম।”

—(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৫) শ্রীমার রামেশ্বর দর্শনের সব ব্যবস্থা শশী মহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) করেছিলেন৷ ১০৮িট সোনার বেলপাতা দিয়ে রােমশ্বরের পূজা করিয়েছিলেন৷ রামনাদের রাজা শ্রীমার আগমনের দরাজ হয়ে তঁার দেওয়ানকে হুকুম দিয়েছিলেন— মন্দিরের রত্নাগার খুলে দেখাতে এবং শ্রীমায়ের যা পছন্দ তা তঁাকে উপহার দিেত৷ ত্যাগীর বাদশা শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী ও নির্বাসনার প্রতিমূর্তি কিভাবে তিনি এই েসানাদানা গ্রহণ করেন? তীর্থযাত্রায় যা কিছু প্রয়োজন তা সব শশী মহারাজই সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন৷ তাই ভক্ত রামনাদের মান রাখতে রাধুকে বলেছেন, েতার যদি কিছু লাগে নিতে পািরস৷ কিন্তু মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন, রাধুর মনে যেন েকান বাসনা না জাগে৷ সব েদখে শুনে রাধু বলে, এ সবা তার দারকার নেই, তার একটি েপন্সিল চাই৷ ঠাকুর রক্ষা করলেন৷ এভাবেই সাধারণ মানুেষর কাছে প্রলোভন আসবে, কিন্তু তা কাটাতে ঠাকুরের কৃপা প্রার্থনা করলে, তি​িন তঁার ভক্তকে প্রলোভনের হাত থেকে রক্ষা করবেন৷ তবে প্রার্থনা হওয়া চাই আন্তরিক এবং বিপদ থেকে সত্যিকারের মুক্তি পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা৷

১৪১

১৪২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বাহাত্তর “কিন্তু মা তাহার পরেই অসুস্থ হইয়া পড়ায় কয়েক মাস পরে ক�োয়ালপাড়া আসেন। একদিন বেলা এগারটা আন্দাজ ‘জগদম্বা আশ্রমে’ গিয়া দেখি মেয়েরা সব চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। কেদারবাবুর মা আস্তে আস্তে বলিতেছেন, “মায়ের ভাবসমাধি হয়েছে। ‘ঠাকুর’—এই কথাটি বলেই অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন।” মেয়েরা মাথায় ও চ�োখে জল দিতে লাগিলেন। কিছু পরে মা সুস্থ হইলে নলিনী দিদি জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিসিমা, অমন হলে কেন?” মা বলিলেন, “কই কি হল�ো? ও কিছু না, ত�োদের ছুঁচে সুত�ো দিতে গিয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।” মায়ের এই কথা শুনিয়া আর কেহ উচ্চবাচ্য করিলেন না।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৬৯-২৭০) কোয়ালপাড়ায় জগদম্বা আশ্রমে ভাবসমাধি হয়েছে শ্রীমায়ের৷ ভক্ত মানুষ কেদারবাবুর মা তাই বলেছেন, ‘ঠাকুর’ এই কথাটি বলেই শ্রীমা অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন৷ সাধারণের ধারণাই নেই ‘ভাবসমাধি’র৷ এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যথাও নেই৷ তাদের দৈনন্দিন জীবন সুখে-শান্তিতেআনন্দে কাটলেই হলো৷ কিন্তু ভগবানের নামে বিভোর

হয়ে ঈশ্বরানুভূতির আনন্দ বা সুখ তা যে নামেই আখ্যাত করা যাউক না কেন৷ সেই ভাবসমাধি শ্রীমায়ের জীবনে ছিল স্বাভাবিক৷ কিন্তু নরলীলায় অবতীর্ণা শ্রীমা সর্বদা সমাধি সুখে মজে থাকলে সাধারণ জীবনযাপন করা যাবে কি করে? জগতের িহতার্থে তিনি সাধারণের ন্যায় জীবন কাটাতেন৷ তবুও মাঝে মধ্যেই তাঁর স্বরূপের বহির্প্রকাশ ঘটেছে৷ নির্জন স্থান েকায়ালপাড়া, মায়ের ৈবঠকখানা, েসখানে তিনি বেশ শান্তিতে সময় অতিবাহিত করেন৷ কিন্তু ভাবসমাধিকে শারীিরক অসুস্থতা বলে শ্রীমায়ের সঙ্গিনীগণ মাঝে মাঝে চি​িন্তত হয়ে পড়েন৷ একবার েচাখে মুেখ জল পেয়ে সুস্থতা েবাধ করলে নলিনী দিদি শ্রীমাকে প্রশ্ন করেন, ‘পিসিমা, অমন কেন হলো?’ শ্রীমা যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলেছেন, ‘ত�োদের ছুঁচে সুত�ো দিতে গিয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।’ একথা অন্যেরা বিশ্বাস করল৷ স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়লেও মহামায়ার মায়ায় সবাইকে মোহিত করে স্বাভাবিকরূপে থাকাতেই বাধ্য করেন তিনি৷ কারণ তঁার খেলা কে বুঝিতে পারে?

১৪৩

১৪৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তিয়াত্তর “একবার পূজনীয়া গ�ৌরী-মা মাকে দর্শন করিতে জয়রামবাটী যাইতেছেন। ক�োয়ালপাড়া হইতে আমাকে সঙ্গে লইয়া বিকালে রওয়ানা হইলেন। জয়রামবাটীর কাছে নদীর ধারে পৌঁছিয়া কিছু বেলা আছে দেখিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার একটু পরে মায়ের সদর দরজায় পৌঁছিয়া আমাকে তথায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি একটু ভিতরে ঢুকিলেন ও ভিখারিদের অনুকরণে বলিয়া উঠিলেন, “মা, দুটি ভিক্ষা পাই, মা।” তাহা শুনিয়া ছ�োট মামী বাহিরে আসিয়া বলিতেছেন, ‘কে গ�ো?’ তখন গ�ৌরী-মা আবার বলিয়া উঠিলেন, “দুটি ভিক্ষা পাই, মা।” ছ�োট মামী তখন খুব ভয় পাইয়া চিত্কার করিয়া একেবারে মায়ের কাছে ছুটিয়া গেলেন। মা চিত্কার শুনিয়া ধীরভাবে বাহির হইয়া আসিয়া দৃঢ়স্বরে বলিতেছেন, ‘কে রে?’ গ�ৌরী-মা পূর্ব স্থানেই দাঁড়াইয়া বলিলেন, “দুটি ভিক্ষা পাই, মা, আমি রাতভিখারি।” অন্ধকারে মা গ�ৌরীমায়ের গলার আওয়াজ পাইয়া বলিলেন, “ও গ�ৌরদাসী, এস এস, কখন এলে?” তারপর খুব রহস্য হইতে লাগিল।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৩) গ�ৌরদাসী ওরফে গ�ৌরী-মা অন্যের স্বর নকল করে খুব ১৪৫

মজা করতে পারতেন৷ একবার তিনি শ্রীমাকে দর্শন করতে জয়রামবাটী যাইতেছেন৷ জয়রামবাটীর কাছে পৌঁছে অন্ধকার নামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন৷ সন্ধ্যা হলে শ্রীমায়ের দরজার গিয়ে ভিখিরিেদর স্বরে ‘মা, দুটি ভিক্ষে পাই গো,’ বলে দাঁড়ালেন৷ এই অসময়ে অন্ধকারে ঐ কণ্ঠস্বর শুনে ছোট মামী বাইরে এসে জানতে চাইলেন ‘েক গা’? আবার েসই আগের মতো স্বরে গ�ৌরী-মা ভিক্ষা প্রার্থনা করেছেন৷ এতে ছোট মামী ভয় পেয়ে িচৎকার করে গৃহাভ্যন্তরে ছুটে গেলে শ্রীমা ঐ িচৎকার শুনে ধীরভাবে বাইরে আসেন৷ তিনি ভীত না হয়ে দৃঢ়স্বরে বলেন, ‘কে রে’৷ আবারও েসই কথা, “দুটি ভিক্ষা পাই, মা, আমি রাতভিখারি।” শ্রীমায়ের কিন্তু গ�ৌরীমার স্বর চিনতে অসুবিধা হয় নি৷ তি​িন বললেন, ‘ও গ�ৌরদাসী, এস এস, কখন এলে?’ আসলে মহামায়ার কাছে মায়ার খেলা—েস তো মায়ের কাছে মাসীর গল্প৷ এরূপ হাসি-ঠাট্টায়, মজায় ভরে থাকত শ্রীমায়ের পার্থিব সংসার৷

১৪৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চুয়াত্তর “ঐ সময়ে যে সেবকটি রাধুর পথ্য তৈয়ার করিত তাহাকে কয়েক দিনের জন্য কলিকাতায় যাইতে হইল। মা ঐ ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এটি পারবে, বাবা?” সে সম্মত হইলে বলিলেন, “ওদের কাছে সব দেখে শুনে নাও।” প্রথম দিনেই পথ্য প্রস্তুত করিয়া মায়ের নিকট লইয়া যাইবার সময় তাহার হাত হইতে সব পড়িয়া নষ্ট হইয়া যায়। তখন কি করা উচিত ঠিক করিতে না পারিয়া সে খালি পাত্রগুলি মায়ের নিকট উপস্থিত করে। সেদিন আর রাধুর খাওয়া হইল না। মা বিরক্ত হইলেন। পরে বলিয়াছিলেন, “সাধু হিসাবে ত�ো ছেলেটি বেশ ভালই। তবে আমার এখানে কাজকর্মে চ�ৌকশ ল�োক চাই। ‘গাছতলার সাধু’ দিয়ে আমার কাজ হবে না। আবার হুজুগে পড়েও অনেক অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলে। কিন্তু মানুষের প্রত্যেক খুঁটিনাটি কাজটিতে শ্রদ্ধা দেখলে ঠিক ঠিক মানুষটি চেনা যায়।” দুই-এক দিন পরেই সেবকটি ফিরিয়া আসায় ছেলেটির ওখানে থাকা হইল না।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৫) ‘গাছতলার সাধু’ দিয়ে শ্রীমায়ের সংসারে কাজ চলে না৷ ১৪৭

এমনই একটি ঘটনায় তা প্রমাণিত৷ রাধুর পথ্যের জন্য যে সেবকটি ছিল, তােক বিশেষ প্রয়োজনে কলকাতায় কয়েক দিেনর জন্য যেতে হয়৷ তখন শ্রীমায়ের েসবাপ্রার্থী এক ছেলে​েক ঐ কাজটি করতে পারবে কিনা শ্রীমা জিজ্ঞাসা করায় সে সম্মত হয়৷ তখন তাকে সব দেখে শুনে নিতে বলা হয়৷ কিন্তু প্রথম দিনই পথ্য প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়ার সময় সব পথ্যটি তার হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয় যায়৷ তাই সেদিন আর রাধুর খাওয়া হলো না৷ শ্রীমা তাই মন্তব্য করেছেন, সাধু হিসাবে ছেলেটি ভালই, তবে এখানে কাজকর্মে চ�ৌকশ লোক চাই৷ কর্মে শ্রদ্ধাহীন সাধু বা ‘গাছ তলার সাধু’ হলে চলে না৷ যে ঠাকুরের মুর্হুমুহু সমাধি হত, যাঁর কাপড়ের ঠিক থাকত না, েসই তিনিই যখন কলকাতায় বেরোতেন, তাঁর জুেতা েজাড়ািট পর্যন্ত থাকত চক্চকে৷ ব্যাবহািরক দিকে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল৷ ঠাকুরের অবর্তমানে শ্রীমায়ের থাকা খাওয়ার জন্য বলরামের কাছে টাকা রেখে যাচ্ছেন৷ কি দায়িত্ববোধ—এই িশক্ষারই প্রয়োজন৷ আর তঁারই নামাঙ্কিত সঙ্ঘের সাধুর অবিন্যস্থ ভাব মানায় না৷ সব দিকে নজর রেখে চলতে হয়৷ প্রত্যেক কাজে সমান শ্রদ্ধা রাখতে হয়৷ ১৪৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁচাত্তর “সেইদিন সন্ধ্যার একটু পরেই সন্ধিপূজা। মায়ের পায়ে পদ্মফুল দিয়া অনেকে পুষ্পাঞ্জলি দিলে মা বলিতেছেন, “আরও ফুল আন; রাখাল, তারক, শরৎ, খ�োকা, য�োগেন, গ�োলাপ— এদের সব নাম করে ফুল দাও। আমার জানা-অজানা সকল ছেলের হয়ে ফুল দাও।” আমি ঐরূপ করিলে মা জ�োড়হাতে ঠাকুরের দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিতেছেন, “সকলের ইহকাল-পরকালের মঙ্গল হ�োক।” কেদার মহারাজ একদিন সকালে জয়রামবাটীতে মায়ের নিকট বসিয়া বলিতেছেন, “মা, আমাদের দাতব্য চিকিত্সালয়ে যাদের অবস্থা ভাল তারাও সব ওষুধ নিতে আসে। আমরা ত�ো গরিবদের জন্যেই করেছি। ঐ সমস্ত ল�োককে ওষুধ দেওয়া কি উচিত?” মা একটু থামিয়া বলিলেন, “বাবা, এদেশের সকলেই গরিব। তবে ওরা এইসব জেনেশুনেও যদি প্রার্থী হয়ে এসে দাঁড়ায়, সামর্থ্য থাকলে দেবে বইকি। যে প্রার্থী সেই গরিব।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৭৮-২৭৯) শ্রীমায়ের অপার করুণায় মূর্ত হয়েছে ‘সকলের ইহকালপরকালের মঙ্গল সাধন।’ সন্ধিপূজায় শ্রীমায়ের পায়ে পদ্মফুল দিয়ে উপস্থিত অনেকে পুষ্পাঞ্জলি দিলে, শ্রীমা আরও পুষ্প ১৪৯

এনে, রাখাল, তারক, শরৎ, খোকা, যোগেন প্রমুখের নামে তাঁর পায়ে দিেত বলেন৷ শুধু তাই নয়, জানা-অজানা সবার হয়ে তঁার শ্রীচরণকমলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে নির্দেশ দেন৷ তারপর শ্রীমা করজোড়ে ঠাকুেরর দিেক চেয়ে স্থির হয়ে প্রার্থনা করেছেন—জগতের সকলের ইহকাল পরকােলর মঙ্গল৷ তিনি যে জগজ্জননী; জগতের হিতার্থেই ধরাতে অবতরণ তাঁর! অন্য প্রসঙ্গে েকদার মহারাজ শ্রীমাকে অভিযোগ করেছেন, তাদের দাতব্য িচকিৎসালয়ে অবস্থাপন্ন লোকেরাও ওষুধ নিতে আসে৷ দাতব্য িচকিৎসালয় সাধারণত গরীব মানুষদের জন্য৷ েসখােন ধনী লোকেদেরও েসই সাহায্য নিেত দেখলে স্বভাবই মনে অশান্তি আসে৷ কিন্তু শ্রীমা এর সুন্দর জবাব দিয়েছেন; প্রার্থীকে ফেরাতে নেই৷ যে প্রার্থী েস গরীব—আর্থিক বা মানসিকভাবে৷ তাই নারায়ণ জ্ঞানে নরের সেবা করাই দাতব্য িচকিৎসালয়ের ধর্ম৷

১৫০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছিয়াত্তর “মা তখন চিত্কার করিয়া বলিতেছেন, “ওগ�ো কে আছ, পাগলী আমায় মেরে ফেললে!” আমি দ�ৌড়িয়া গিয়া দেখি, কাঠখানি প্রায় মায়ের মাথায় ফেলেন আর কি! তাড়াতাড়ি উহা দূরে ফেলিয়া দিয়া মামীকে সদর দরজা পার করিয়া দিলাম। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া পুনরায় সে বাড়িতে আসিতে নিষেধ করিলাম। মাও তখন উত্তেজিত হইয়া বলিয়া ফেলিলেন, “পাগলী, কি করতে বসেছিলি? ঐ হাত ত�োর খসে পড়বে।” ইহা বলিয়াই জিব কাটিয়া মা শিহরিয়া উঠিলেন। ঠাকুরের দিকে চাহিয়া জ�োড়হাতে বলিতেছেন, “ঠাকুর, একি করিলাম! এখন উপায় কি হবে? আমার মুখ দিয়ে ক�োনদিন ত�ো কারও ওপর অভিসম্পাত-বাক্য বের�োয়নি, শেষটায় তাও হল�ো? আর কেন?” মায়ের অপার করুণার ভাব দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮১-২৮২) শ্রীমায়ের সংসারের একটি খণ্ডচিত্র৷ নানা অশান্তির মধ্যে বসবাস করছেন তিনি৷ পাগলী মামী একদিন শ্রীমায়ের

মাথায় জ্বালানি কাঠের আঘাত করতে উদ্যত হলে শ্রীমা চিৎকার করছেন—‘পাগলী আমায় মেরে ফেললো’৷ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হলেও শ্রীমা উত্তেজিত হয়ে বলে ফেললেন, ‘পাগলী, কি করতে বসেছিলি? ঐ হাত ত�োর খসে পড়বে’। বলামাত্রই বোধে ফিরলেন৷ এমন অভিশাপ বাক্য তো কাউকে তিনি বলেন নি৷ সঙ্গে সঙ্গে েজাড় হাতে ঠাকুরের কােছ বলেছেন, “ঠাকুর, একি করলাম! এখন উপায় কি হবে? আমার মুখ দিয়ে ক�োনদিন ত�ো অভিসম্পাত-বাক্য বের�োয়নি, শেষটায় তাও হল�ো?’ এমনই বিপরীতভাবের সমন্বয় দেখা গিয়েছিল শ্রীমায়ের মধ্যেও৷ অপার করুণায় শ্রীমায়ের এই পাগলীদের নিয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহ করা—সত্যই এক পরীক্ষণীয় ব্যাপার৷ ৈধর্য্যের বঁাধ যথাযথ রাখা কষ্টসাধ্য৷ কিন্তু অসীম ক্ষমাশীলতা যাঁর মধ্যে বর্তমান; তাঁরই এই অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের কি পরিণতি হবে? ছারখার হয়ে যাবে সংসার; জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে জীবন৷ পরিত্রাণে চাই অন্তরের আকুল প্রার্থনা৷

১৫১

১৫২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতাত্তর “সকালে কলিকাতা হইতে কয়েকটি ভক্ত আসিয়াছেন, বেশ ফিট্ফাট্। কাপড়-জামার খুব প্রাচুর্য। মায়ের জন্য ফল প্রভৃতি অনেক জিনিস আনিয়াছেন। মা বিকালে আপন মনে বলিতেছেন, “সব জ্বালিয়ে খেলে! আর পারিনে। এক একটি ছেলে আসে, আমার সংসারটি যেন শান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। ক�োথা থেকে সব তরিতরকারি জিনিসপত্রের য�োগায�োগ হয়ে যায়। আমাকে ক�োন ভাবনা চিন্তা করতে হয় না। যা হল�ো, মুখটি বুজে খেয়ে পাতাটি গুটিয়ে নিয়ে উঠে গেল। আহা, তাদের মুখের কথাটিতেও যেন প্রাণটি শীতল হয়! আর এই দেখ না, সকাল থেকে যেন উদ্ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। একগাদা ফল নিয়ে এল। তার অর্ধেক পচে গ�োবর হয়ে গেছে। সেগুলি ফেলি ক�োথায় তা খুঁজে পাইনে। এদিকে অমন ফরসা কাপড়-চ�োপড়, বলে, ‘গামছা আনতে ভুলে গেছি।’ আমি গামছা পাই ক�োত্থেকে? তখন ত�ো একটা দেখেশুনে দিলাম। এখন ভাবনা, রাত্রে যে কি তরকারি করি! আবার শুনছি, মশারির দড়ি নেই; হরি দড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর, ত�োমার সংসার তুমি দেখ গিয়ে। আমি ত�ো আর পেরে উঠছি না। এদিকে রাধি, আর ওদিকে এইসব।”

—(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৪) ঠাকুর শ্রীমােক কলকাতার েলাকদের উন্নতির জন্য বলেছিলেন৷ তাতেই শ্রীমা অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন৷ এটি তারই নমুনা! কলকাতার কয়েকটি ভক্ত সেজে গুেজ প্রচুর ফল এনেছে শ্রীমায়ের জন্য৷ কিন্তু নিত্য ব্যবহার্য গামছা আনতে ভুলে গেছে অার অানীত ফলের অর্ধেকই পচা! শ্রীমায়ের এতে কষ্টের সীমা নাই৷ এরা বাইরে দেখনদার, কিন্তু অন্তঃসারশূন্য৷ শ্রীমায়ের অন্য অভিজ্ঞতায় আছে, কেউ কেউ এলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়৷ যা খেতে দেওয়া হয় তাই ভক্তি ভরে খেয়ে নেয়৷ তাদের সঙ্গে কথা বললেও মনে শান্তি হয়৷ কেন না তাদের অন্তর ভক্তিরসে পূর্ণ ও পবিত্র৷ ভগবৎপদে অন্তলীন ভক্তের সঙ্গ শ্রীমা অত্যন্ত ভালবাসেন৷ তাই তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের সুব্যবস্থা তিনি করেন৷ তাদের ইহকাল পরকালের সব দায়দায়িত্ব তঁার৷ কলকাতার এই ভক্তদের মতো তাদের সাজগোজ ধোপদুরস্ত না হতে পারে, কিন্তু অন্তরের নির্মল আবেদন তিনি বুঝতে পারেন৷ এই রকম ভক্ত হওয়ারই চেষ্টা করলে শ্রীমায়েরও শান্তি আর নিজেদেরও মঙ্গল৷

১৫৩

১৫৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটাত্তর “মা শ্রীযুত শ্যামাদাস কবিরাজের চিকিত্সায় কয়েকদিন একটু ভাল আছেন। ঐ সময়ে একদিন বিকালে কয়েকজন স্ত্রী-ভক্ত দর্শন করিতে আসিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে একজনের অলঙ্কার বেশভূষার খুব পরিপাট্য। একটু চঞ্চল। মা তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “দেখ, স্ত্রীল�োকের লজ্জাই হল�ো ভূষণ। ফুলটি দেবসেবায় লাগলেই সব চেয়ে সার্থক; না হয় গাছেই শুকিয়ে যাওয়া ভাল। কিন্তু আমার দেখে বড় কষ্ট হয়, যখন বাবুরা ফুলটি কখন�ো ত�োড়া করে, কখন�ো বা এমনি হাতে নিয়ে নাকের কাছে একবার ধরে বলে, ‘বাঃ, বেশ ত�ো গন্ধটি!’ ও মা, পরক্ষণেই হয়ত�ো মেঝেয় ফেলে দিয়েছে! জুত�োয় মাড়িয়েই হয়ত�ো চলেছে। চেয়ে দেখলে না।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৭) একদিন কয়েক জন ভক্ত স্ত্রীলোক শ্রীমাকে দর্শন করতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে একজনের ছিল অলঙ্কার ও বেশভূষার খুব পরিপাট্য। কিন্তু েস একটু চঞ্চল। শ্রীমা তাদের দেখে ‘স্ত্রীলোকের লজ্জাই ভূষণ’—এ গূঢ় কথাটি বলেছেন৷ আরও বলেন, ফুল দেব-সেবায় লাগে৷ তা যদি না হয় তো গাছেই শুকিয়ে যাওয়া ভাল৷ কারণ, তঁার আক্ষেপ েকান বাবু েসই ১৫৫

ফুলের তোড়া করে বা এমনি নাকের কাছে নিয়ে ‘বাঃ, বেশ ত�ো গন্ধটি’ বলে ঘ্রাণ নিয়ে, পরেই ফেলে দিয়ে পায়ে মািড়য়ে চলে যায়৷ শ্রীমায়ের এই দৃষ্টান্তের পেছনে যে ইঙ্গিতটি রয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ৷ এখানে স্ত্রীেলাককে তিনি ঐ ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন৷ কি অপূর্ব উপমা! দৈবীসত্তার বিকাশ না করে মনোমোহিনীরূপের যে প্রকাশ তা েবদনাদায়ক ও নিন্দনীয়৷ শ্রীমা চাইতেন—প্রত্যেক নারী তার স্বীয় সত্তায় সম্পূর্ণতা লাভ করুক৷ নিবেিদতা স্কুলের নারীদের দৃষ্টান্তস্বরূপ তাই তুলে ধরতেন৷ তােদর িশক্ষার অনন্যতা, হাতের কাজের পারদর্শিতা, স্বাবলম্বী হওয়ার মানসিকতা ছিল নারীর প্রকৃত জীবনচর্যা৷ পরাধীনতা, পরমুখাপেক্ষী হওয়া তিনি সহ্য করতে পারতেন না৷ স্বাধীন চিন্তা ও মননে প্রকৃত ভারতীয় নারী হয়ে উঠবে, তার মাতৃসত্তার জাগরণ হবে—এই িছল প্রত্যেক নারীর কাছে তঁার কামনা৷ ব্যতিক্রমে কষ্ট অনুভব করতেন, বেদনাতুর হতেন, দুঃেখ ভারাক্রান্ত হতেন৷ তাদের মঙ্গলের জন্য তিনি সদা সর্বদা জাগরূক ছিলেন৷ প্রত্যেকে যাতে প্রকৃত নারী হতে পারেন, তাই প্রার্থনা করতেন৷ সঙ্গে সঙ্গে নারীসত্তার অবমাননায় তিনি রুখেও দঁাড়াতেন৷ ১৫৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উনাশি “একদিন দুপুরে রাধু পাশের ঘরে ঘুমাইতেছে, তাহার খ�োকা হামা দিতে দিতে মায়ের বিছানার নিকট আসিয়া তাঁহার বুকের উপর উঠিতেছে। মা তাহা দেখিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “ত�োদের মায়া একেবারে কাটিয়েছি। যা, যা, আর পারবিনে।” আমাকে বলিলেন, “একে তুলে নিয়ে গিয়ে ওদিকে রেখে এস। এসব আর ভাল লাগে না।” আমি খ�োকাকে ক�োলে করিয়া তাহার দিদিমার নিকট দিয়া আসিলাম। জয়রামবাটীতে একদিন একজন ছ�োট মামীকে একটু রূঢ় কথা বলায় মা বলিতেছেন, “ওকি গ�ো, মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কি কথা বলতে আছে? কথা সত্য হলেও অপ্রিয় করে বলতে নেই। শেষে ঐরূপ স্বভাব হয়ে যায়। মানুষের চক্ষুলজ্জা ভেঙে গেলে আর মুখে কিছু আটকায় না। ঠাকুর বলতেন, “একজন খোঁড়াকে যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়, তুমি খোঁড়া হলে কি করে?—তাহলে বলতে হয়, ত�োমার পা-টি অমন ম�োড়া হল�ো কি করে’?” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৮৯) জগতের মায়া কাটিয়ে দিেয়ছেন শ্রীমা৷ তাই রাধুর খোকা হামাগুড়ি দিয়ে শ্রীমায়ের কাছে আসতে চাইলে তাকে নিয়ে

যাবার জন্য বলেছেন এবং তিনি যে এখন মায়ামুক্ত েস কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন৷ রাধুকে দেখিয়ে ঠাকুরের শরীর যাওয়ার পরও মহামায়াস্বরূপিণী শ্রীমাকে শরীররক্ষার কথা বলেছিলেন৷ তিনি তাই এতদিন করেছেন৷ এখন েসই শ্রীমায়ের মর্ত্যধাম ত্যাগের সময় এসেছে, তারই ইঙ্গিত দিয়ে দিচ্ছেন৷ জয়রামবাটীতে একদিন ছোট মামীকে একটু রূঢ়ভাবে কথা বলতে শুনে শ্রীমা উপদেশ দিয়েছেন, কাউকে আঘাত দিয়ে কথা না বলতে৷ সত্য কথা হলেও অপ্রিয়ভাবে তা বলতে নেই৷ মানুেষর একবার চক্ষুলজ্জা ভেঙে গেলে মুখে আর কিছু আটকাবে না৷ ঠাকুেরর কথায় ‘একজন খেঁাড়াকে যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়, তুমি খোঁড়া হলে কি করে’?— ‘তাহলে বলতে হয়, ত�োমার পা-টি অমন ম�োড়া হল�ো কি করে’৷ মিষ্ট কথায় যা জানার বা বলার থাকে তাই করতে হয়৷ এই সদর্থক ভাবটি অভ্যাস হয়ে গেলে অসুবিধা হয় না, কিন্তু তা না হলেই যত সমস্যা উপস্থিত হয়৷ এই সব কথা মনে রেখে সচেতন হয়ে কথাবার্তা বললে নিজেদের জীবন মঙ্গলময় হয়ে ওঠে৷

১৫৭

১৫৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আশি “একদিন মা বলিতেছেন, “এত জপ করলামই বল, আর এত কাজ করলামই বল, কিছুই কিছু নয়। মহামায়া পথ ছেড়ে না দিলে কার কি সাধ্য! হে জীব, শরণাগত হও, কেবল শরণাগত হও। তবেই তিনি দয়া করে পথ ছেড়ে দেবেন।” এই বলিয়া কামারপুকুরে অবস্থানকালে ঠাকুরের জীবনের একটি ঘটনা বলিলেন, “একবার কামারপুকুরে জ্যৈষ্ঠমাসে দিন বৈকালে খুব বৃষ্টি হয়ে মাঠ সব জলে উপচে গেছে। ঠাকুর ড�োমপাড়ার কাছে নিচু সদর রাস্তা দিয়ে এতখানি জল ভেঙে মাঠে শ�ৌচে যাচ্ছেন। সেখানে অনেকে মাগুর মাছ উঠেছে দেখে লাঠি দিয়ে মারছে। একটি মাগুর মাছ ঠাকুরের পায়ে পায়ে কেবল ঘুরছে। তাই দেখে তিনি বলছেন, ‘এটিকে মারিসনে রে, এটি আমার পায়ে পায়ে শরণাগত হয়ে কেমন ঘুরছে। কেউ যদি পারিস ত�ো একে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আয়।’ তারপর নিজেই সেটিকে ছেড়ে দিয়ে এসে বাড়িতে বলছেন, ‘আহা, কেউ যদি এই রকম শরণাগত হয় তবেই সে রক্ষা পায়’।” —(স্বামী ঈশানানন্দ, পৃঃ ২৯০) শ্রীমা বলেছেন, জপধ্যান বা কাজ করা যাই হোক, কিছুেত কিছু হয় না৷ মায়াধীশ পথ ছেড়ে না দিেল কার কি ১৫৯

সাধ্য? তাই হে জীব শরণাগত হও, েকবল শরণাগত হও, তবেই তিনি দয়া করে পথ ছে​েড় দে​েবন৷ তাঁর দয়া না হলে মুক্তি সম্ভব হবে না৷ অনে​েক ভেবে থাকে, অনেক জপধ্যান করেছি, এতে কিছুটা অহঙ্কার আসে, অনেক নিষ্কাম কর্ম করেিছ, অারও কিছু অহঙ্কার বাড়ল৷ ভাবছে, এইবার ভগবানের দয়া হবেই হবে৷ কিন্তু তা নয়৷ কেবলমাত্র তঁার দয়াতেই সব সম্ভব৷ একটি ঘটনায় শ্রীমা বলেছেন, কামারপুকুরে জ্যৈষ্ঠমাসে একদিন বিকালে খুব বৃষ্টি হওয়ায় মাঠ উপচে জল নামছে৷ ঠাকুর ডোমপাড়ার নিচু সদর রাস্তা দিয়ে জল েভঙে মাঠে শ�ৌেচ যাচ্ছেন৷ একটি মাগুর মাছ ঠাকুরের পায়ে পায়ে কেবল ঘুরছে৷ ঠাকুরের দয়া হলো৷ সেই মাগুর মাছকে পুকুরে ছেড়ে েদওয়ার জন্য একজনকে আহ্বান করেছেন৷ অবশেষে নিজেই েসটিেক পুকুরে ছেড়ে দিয়ে এসে বলেছেন, ‘আহা, কেউ যদি এই রকম শরণাগত হয় তবেই সে রক্ষা পায়’। এই শরণাগত ভাব নিয়ে আসতে পারলেই জীবের মুক্তি; নতুবা বারে বারে গতায়াত আর সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ৷

১৬০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একাশি “ধ্যানজপের কথা উঠায় মা বলিলেন, “ধ্যানজপের একটা নিয়মিত সময় রাখা খুব দরকার। কারণ কখন যে ক্ষণ বয়, বলা যায় না। ও হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়—টের পাওয়া যায় না। সেজন্য যতই গ�োলমাল হ�োক, নিয়ম রাখা খুব দরকার।” আমি—কাজের ঝঞ্ঝাট বা অসুখ প্রভৃতি আছে; সেজন্য সকল সময় নিয়ম রাখা সম্ভব হয় না। মা—অসুখ হলে ত�ো আর আয়ত্ত নেই। আর নেহাত যদি কাজের ঝঞ্ঝাট থাকে, তবে স্মরণ প্রণাম করলেও হয়। আমি—কখন সময় করা কর্তব্য? মা—সন্ধিক্ষণেই তাঁকে ডাকা প্রশস্ত। রাত যাচ্ছে, দিন আসছে, দিন যাচ্ছে, রাত আসছে—এই হল�ো সন্ধি। এই সময় মন পবিত্র থাকে। মনের দুর্বলতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় মা বলিয়াছিলেন, “বাবা, ওটা প্রকৃতির নিয়ম; যেমন অমাবস্যা, পূর্ণিমা আছে না? তেমনি মনও কখন�ো ভাল কখন�ো মন্দ হয়।” —(শ্রীনলিনবিহারী সরকার, পৃঃ ২৯১)

জপধ্যানের প্রসঙ্গে শ্রীমা সময় নির্ণয়ের উপায় জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সন্ধিক্ষণ’ জপধ্যানের জন্য প্রশস্ত। ঐ সময় মন শান্ত ও পবিত্র থাকে, পরিবেশও অনুকল ূ । যা না হয় বেশি সময়ে, তা হয় ক্ষণের গুণে, তখন তা সহজে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। দিন যাচ্ছে, রাত্রি আসছে, রাত্রি যাচ্ছে, দিন আসছে—এমন সময়ই ‘সন্ধিক্ষণ’। তবে ব্রাহ্মমুহর্ত ূ ই হল�ো প্রকৃষ্ট সময়। এছাড়াও প্রত্যেকদিন একটা নিয়ম করে জপধ্যান করার কথাও তিনি বলেছেন। ভাল লাগুক বা না লাগুক, মন বসুক বা না বসুক, জপধ্যান ছাড়া উচিত নয়। মনের অবস্থা অমাবস্যা-পূর্ণিমার মত। কখন�ো ভাল, কখন�ো মন্দ যা প্রকৃতির নিয়মের মতো৷ তাকে উপেক্ষা করে গুরু নির্দিষ্ট পথে চলার অভ্যাস করতে হবে। তাহলেই মনের চঞ্চল ভাব প্রশমিত হয়ে শান্ত এবং ঈশ্বরপাদপদ্মে নিবিষ্ট হবে। অন্তিমে ঐ অভ্যস্ত মনের দ্বারাই ভক্তের মনোদর্পণে ভগবানের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে। কখন�ো বৃথা সময় নষ্ট বা অবহেলায় তার অপব্যবহার করতে নেই৷ সময়ের সদ্ব্যবহার একান্ত কাম্য। মনকে সক্রিয় না রাখলে তার মন্দ গতি সম্ভাবনা বেশি। স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় মনকে সর্বদা কলুষমুক্ত ও পবিত্র রাখতে হয়।

১৬১

১৬২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বিরাশি “মা দেখিয়াই বলিলেন, “উত্সব দেখনি ত�ো?” “না, মা, উত্সব দেখা হয় নাই” বলিয়া রাস্তার ঘটনা বলিলাম। তাহা শুনিয়া মা বলিলেন, “য�ো স�ো করে আগে উদ্দেশ্যসাধন করে নিতে হয়। এইত�ো, বাবা, এত সব দেখতে পেলে না। আগের কাজ আগে করতে হয়।” পরে বলিলেন, “কালকে এখানে এসে ঠাকুরের প্রসাদ পেও।” আহারসম্বন্ধে মা বলিতেন, “যখনই যা-কিছু আহার করবে, তা ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদস্বরূপর গ্রহণ করবে। তাহলে রক্ত শুদ্ধ হবে, রক্ত শুদ্ধ হলে মনও শুদ্ধ হবে।” একদিন ক�োন কারণে মা তাঁহার ভাইদের উপর বিরক্ত হইয়াছিলেন। আমি ঐ সময়ে গিয়া উপস্থিত হইলে আমাদের ঐ সম্পর্কে দু-একটি কাহিনী বলিয়া বলিলেন, “বাবা, ওরা কেবল টাকা টাকা করেই গেল! কেবল ‘ধন দাও, ধন দাও’—ভুলেও কখন�ো জ্ঞান ভক্তি চাইলে না। যা চাচ্ছিস, তাই নে!” —(শ্রীনলিনবিহারী সরকার, পৃঃ ২৯৩) ঠাকুরের উৎসব দর্শন না করায় শ্রীমা ভক্তদের উদ্দেশ্যে

বলেছেন, য�ো স�ো করে উদ্দেশ্য সাধন করে নিতে। ঠাকুর যেমন বলেছেন, যেন তেন প্রকারেণ ধাক্কা খেয়েও আগে কালী দর্শন করতে হয়; তার পর কাঙালী ভ�োজন ইত্যাদি। আগের কাজ আগে করতে হয়, সকালের কাজ রাতে করলে হয় না৷ আবার আহার সম্বন্ধেও শ্রীমা বলেছেন, যা কিছু আহার করবে তা মনে মনে ঈশ্বরকে অর্পণ করে প্রসাদরূপে ধারণ করলে আহার শুদ্ধিতে রক্ত আর তা থেকে মন শুদ্ধ হয়৷ সেই মনে ঈশ্বরের অনন্য চিন্তা হয়। ভগবত পাদপদ্মে নিবেদিত মনের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। কারণ যে আসনে ভগবান অধিষ্ঠান করবেন তা তাঁর উপযুক্ত হওয়া চাই। শ্রীমা তাঁর নিজের ভাইদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা শুধু ‘টাকা দাও, টাকা দাও’ করে, একবারও জ্ঞান ভক্তি চায় না। অথচ যে চায় েস তা পায়৷ একবার মুখ ফুটে চাইলেই হলো। কিন্তু তারা তা না চেয়ে সাংসারিক চাল, কুমড়া, পটলে আবদ্ধ দেখে শ্রীমা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আসলে মহামায়াস্বরূপিণী নিজেই তো য�োগমায়ায় সকলকে ভুলিয়ে রাখেন, জীবের সাধ্য নাই তা অতিক্রম করে৷ তিনি সকলের মধ্যে অবস্থান করে ‘যন্ত্র রুঢ়ািণ মায়য়া’ যন্ত্রের মত চালাচ্ছেন।

১৬৩

১৬৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তিরাশি “একদিন বীজমন্ত্রের প্রসঙ্গে সব মন্ত্র আমাকে বলিয়া বলিলেন, “আমার সব থলে ঝেড়ে দিলুম। তুমি মন্ত্র দেবে নাকি?” আমি—মা, আমাকে সর্বত্যাগী করে দিন, যেন কিছুতেই টান না থাকে। মা—সর্বত্যাগী ত�ো আছই, আবার কি দুট�ো শিং বেরুবে? আর একদিন জয়রামবাটীতে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “কি করে ভগবান লাভ হয়? পূজা, জপ, ধ্যান—এসবে হয়?” আমি—তবে কিসে হয়? মা—শুধু তাঁর কৃপাতে হয়। তবে ধ্যানজপ করতে হয়। তাতে মনের ময়লা কাটে। পূজা, জপ, ধ্যান—এসব করতে হয়। যেমন ফুল নাড়তে চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবৎতত্ত্ব আল�োচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। নির্বাসনা যদি হতে পার, এক্ষুণি হয়।” —(স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, পৃঃ ২৯৬) ১৬৫

‘কি করলে ভগবানালাভ হয়’—এরকম প্রশ্ন শ্রীমােক করা হলে তিনি বলেছিলেন, েকবলমাত্র তঁার কৃপাতেই সম্ভব৷ আরও একটি পথ আছে—তা হলো নির্বাসনা হওয়া৷ শুনতে এটি সহজ মনে হলেও বাস্তবে হওয়া বড়ই কঠিন৷ প্রতি প্রশ্ন—তাহলে জপ, ধ্যান, পূজা, পাঠ করা কেন? এ সব করলে মনের ময়লা কাটে, দর্পণ স্বচ্ছ হলে তাতে যেমন প্রতিবিম্ব পরিষ্কার দেখা যায়, েতমনি পবিত্র মনের হৃদকমলে তঁার প্রতিফলন উজ্জ্বলতম হয়ে ওঠে৷ সহজ উদাহরণ—ফুল নাড়তে নাড়তে যেমন ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘঘতে ঘঘতে যেমন গন্ধ বের হয়, েতমনি ভগবৎতত্ত্ব আলোচনায় মনোনিবেশ করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়৷ সর্বত্যাগী হতে চাইলে কি করতে হবে—এরকম প্রশ্ন করলে শ্রীমা বলেছেন; সর্বত্যাগী অনেকই কিন্তু তার বহির্লক্ষণ কিছু থাকবে না,অথচ আভ্যন্তরীন পরিবর্তন হয়ে যাবে৷ তখন জগতের অনিত্যতা এবং ভগবানের নিত্যতা সম্পর্কে সংশয়াতীত ধারণা হবে৷ ভগবৎ অনুভূতি হবে কিন্তু সর্বসমক্ষে তার কোন প্রতিফলন হবে না৷ সবার মতো চলবে, ফিরবে, কথা বলবে; কিন্তু ভগবৎ অনুভূিততে ভরপুর থাকবে নিরন্তর৷ ১৬৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চুরাশি “একদিন সেজদিদি, নদিদি, মানি ও আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। সেজদিদি মায়ের নিকট মানি ও নদিদির দীক্ষার কথা বলিলেন। তাহাতে মা ক�োন কথা বলিলেন না। পরে সেজদিদি আবার দীক্ষার কথা তুলিলেন। মা বলিলেন, “কুলগুরু ত�ো আছে, সেখানে নিলেই হয়।” কথাগুলি মা যেন একটু গম্ভীরভাবে বলিলেন। একটু পরেই সেজদিদি সে ঘর হইতে উঠিয়া গেলেন। আমি বসিয়াছিলাম। তখন মা বলিলেন, “দীক্ষা দেওয়া কি অমনি কথা, তার পাপের ভার সব নিতে হয়!” একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, ঠাকুরের জপ ত�ো আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনার জপ কি করে করব?” তাহা শুনিয়া মা বলিলেন, “রাধা বলে পার, কি অন্য কিছু বলে পার, যা ত�োমার সুবিধা হয় তাই করবে। কিছু না পার, শুধু মা বলে করলেই হবে।” —(শ্রীমতী শৈলবালা চ�ৌধুরী, পৃঃ ২৯৮-২৯৯) শ্রীমায়ের আশ্রিতা ভক্ত তার নিকট আত্মীয়াদের দীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে, শ্রীমা কুলগুরুর কথা উত্থাপন করেছেন। সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কুলগুরুর

একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এক একটি পরিবারের সবার দীক্ষার দায়িত্ব তাঁরা নিয়ে থাকে। যজমানী বৃত্তি অবলম্বনে তাদের সংসার প্রতিপালিত হয়। ঠাকুরের আগমনের পর এর ব্যতিক্রম দেখা দিয়েছে। কিন্তু শ্রীমা এই প্রথাকে মান্যতা বা গুরুত্ব দিতেন। শ্রীমা দীক্ষা দিলে দীক্ষিতদের পাপাদি যে গ্রহণ করতে হয়, তাও মাঝে মধ্যে মনে করিয়ে দিতেন। শুধু তাই নয়, কখন�ো কখন�ো আক্ষেপের সুরে তঁাকে বলতে শ�োনা গেছে, ঠাকুর সব সেরা ভক্তদের কৃপা করেছেন, আর জল মেশান�ো দুধের ন্যায় অতি সাধারণ ভক্তদের তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক�োন এক ভাগ্যবতী একান্ত সাক্ষাৎকারে শ্রীমায়ের কাছে জানতে চেয়েছেন, কিভাবে তাঁর জপ করবে? গুরুরূপী শ্রীমায়ের উত্তর—‘রাধা’ বা সুবিধামত নামে অথবা শুধুমাত্র ‘মা’ বলে জপ করলেই হবে। শ্রীমাকে ‘মা’ রূপে ডাকতে পারলে জীবন ধন্য হয়ে যায়। জগৎ জননীকে ‘মা’ জ্ঞানে জপ করতে পারলে জীবনের সব রকম বন্ধন ম�োচন হয়ে যায়। সর্ববাধা মুক্ত হয়ে পরপারে যাওয়ার পারানি সংগ্রহ সহজ হয়৷ তাই কেবলমাত্র ‘মা’ নামেই মত্ত থাকা ভাল।

১৬৭

১৬৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁচাশি “শ্রীশ্রীমায়ের পাদপদ্মে দিবার মানসে আমার মা ও আমি একদিন ফুল বিল্বপত্র ও তুলসী লইয়া মায়ের বাটীতে যাই। গ�োলাপ-মা ত�ো আমাদের দেখিয়াই রাগিয়া উঠিলেন। আমরা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। পরে মাকে বলিলাম, “মা, এই ফুল এনেছি আপনার পায়ে দেব বলে।” মা বলিলেন, ‘দাও।’ আমি বলিলাম, “মা, জল ক�োথা পাব?” মা বলিলেন, “ঐ যে, নাও না।” জল লইয়া সামান্যভাবে শ্রীশ্রীমায়ের পায়ে একটু দিয়া ফুল বিল্বপত্র ইত্যাদি দিতে যাইতেছি, এমন সময় মা বলিলেন, “তুলসি-বিল্বপত্র দিও না, শুধু ফুল দাও।” শুধু ফুল মায়ের পায়ে দেওয়া হইয়া গেলে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, এ ফুল কি করব?” মা বলিলেন, ‘নিয়ে যাও।’” —(শ্রীমতী শৈলবালা চ�ৌধুরী, পৃঃ ৩০০) ‘আপনি করিলে আপনার পূজা’—ঠাকুর নিজে তাঁর পূজা করেছিলেন। কিন্তু শ্রীমাও ভক্তদের দিয়ে স্বয়ং তা করিয়েছেন। একজন ভক্ত ফুল, বিল্বপত্র ও তুলসীপত্র শ্রীমার চরণে অঞ্জলি দিতে চাইলে, তিনি শুধু ফুল দিতে বললেন। বিল্বপত্র ও তুলসীপত্র দিতে নিষেধ করলেন। ভক্তের মাধ্যমেই ভগবানের পূজা হয়ে থাকে। কিন্তু ক�োন দেবতার কি নৈবেদ্য প্রথমে

ভক্তদের পক্ষে জানা না থাকলেও ভগবানই তা জানিয়ে দেন। যেমন জগন্নাথ দর্শনে বেরিয়ে পথ ভুললে পথিকরূপী প্রভু তা শুধরে দেন, তেমনি যে শ্রীমায়ের করুণায় সিক্ত ভক্ত হতে চায়, তার মানসিক পবিত্রতা, আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসাই পারে তাকে তঁার সন্নিধানে নিয়ে আসতে। শুভ সংস্কারের প্রাবল্য থাকলেই এটি সম্ভব হয়৷ সাধারণের ধারণা দেবীকে ঢের সারি উপঢ�ৌকন দিলে তিনি খুশি হবেন, কিন্তু আদ�ৌ তা নয়। তিনি অন্তরের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস দেখেন৷ ফল, ফুল, বেলপাতা, জল শ্রদ্ধা সহকারে নিবেদিত হলেই তিনি গ্রহণ করেন। যেমন দুর্যোধনের রাজপ্রসাদের অহং মিশ্রিত রাজভ�োগ পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ গরিব বিদুরের খুদ কুড়ো ঁ খেতে গিয়েছিলেন। শ্রীমাকে ধনীর প্রচারধর্মী প্রাচর্যু ভরা ৈনবেদ্য তৃপ্তি দিতে পারে না। গরীবের নিজের বাড়ির সামান্য পাকা কলা ভক্তি ও যত্ন সহকাের নিবেদিত হলে িতনি তা গ্রহণ করেন। তাই ডাকাত আমজাদের শ্রদ্ধাভরে দেওয়া জিনিসও তিনি ঠাকুরকে নিবেদন করতে দ্বিধাব�োধ করেননি।

১৬৯

১৭০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছিয়াশি “আমি মাকে বলিলাম, “মা, ওর কি হয়েছে—বামুন দেখলে প্রণাম করে, গরু দেখলে প্রণাম করে!” মা বলিলেন, “জীবে দয়া হয়েছে।” এক ক�োজাগরী পূর্ণিমার দিন মায়ের পাদপদ্মে ফুল দিবার মানসে উপবাস করিয়া হরিচরণ ও আমি ‘উদ্বোধনের’ বাটীতে যাই। মায়ের পায়ে ফুল দিয়া আমরা প্রণাম করিলাম। মা হরিচরণকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “লক্ষ্মীশ্রী হ�োক, দীর্ঘায়ু হও।” শ্রীশ্রীমা আমাকে বলিলেন, “সকলকে দেখলে আমি শান্তি পাই; ত�োমার মুখের গ্রাস উপযুক্ত ছেলে চলে গেছে, ত�োমাকে দেখলে বড় কষ্ট হয়।” একদিন মাকে বলিলাম, “মা, ঠাকুরের পাদপদ্মে যেন ভক্তি হয়।” মা বলিলেন, “ভক্তি করতে করতে হবে।” যেদিন আমি সকালে মায়ের ওখানে যাইতাম, মা রাধুর খাওয়ার পর ঠাকুরের ভ�োগের আগেই আমাকে ভাত খাওয়াইতেন। বলিতেন, “পুত্রশ�োকে ত�োমার বুক শুকিয়ে গেছে, তুমি আগে খাও।” আমি বলিলাম, “একে অন্নের কষ্ট, আবার ঠাকুরের ভ�োগের আগেই খাব?” মা বলিলেন, “তুমি কখন�ো অন্নের কষ্ট পাবে না।”

—(শ্রীমতী, পৃঃ ৩০১-৩০২) একজন ভক্ত যত্রতত্র প্রণাম করছে দেখে, আরেক ভক্ত শ্রীমার কাছে তার কারণ জানতে চাওয়ায় শ্রীমা বলেছেন, ওর জীবে দয়া হয়েছে। ঈশ্বর দয়াময়৷ তাই তার ব্রহ্মদর্শনে এই অবস্থা৷ শ্রীমাকে ক�োজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন পায়ে পুষ্পাঞ্জলী দিলে তিনি ‘লক্ষ্মীশ্রী ও দীর্ঘায়ু’ কামনা করেন। শ্রীমায়ের কাছে ভক্তের আবদার, তার যেন ঠাকুরের প্রতি অচলা ভক্তিলাভ হয়। শ্রীমা বলেছেন, ভক্তি করতে করতে হবে। এখানে অভ্যাস য�োগের কথা বলা হয়েছে। মনের মধ্যে ঈশ্বরের চিন্তন থাকলে ভক্তি লাভ সহজে হয়ে থাকে৷ পুত্র শ�োকাতুরা জননীকে শ্রীমা ঠাকুরের ভ�োগ নিবেদনের পূর্বেই খেতে দিয়েছেন। তাই তার জিজ্ঞাসা, এতে অমঙ্গল হবে না ত�ো? শ্রীমায়ের আশ্বাস প্রদান—অসহনীয় পুত্রশ�োকে তার বুক শুকিয়ে গেছে৷ তাই ভাল খাওয়া প্রয়োজন, এটি শ্রীমায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সময়োপয�োগী উপদেশ। শরীর ভাল থাকলে, ভগবানের নাম গুণগান ঠিকমত করা যায়। কিন্তু মন শরীরে পড়ে থাকলে মনকে শরীর থেকে তুলতে হয় এবং সেই মন ঈশ্বর পাদপদ্মে দিতে হয়।

১৭১

১৭২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতাশি “মা—ত�োমাদের স্কুলের ছুটি হল�ো? কটা বেজেছে? সুধীরা দিদি—আজ আমাদের সকাল সকাল ছুটি হয়েছে, এখন সাড়ে-তিনটে বেজেছে। তাই এদের নিয়ে এলুম। মা—তা বেশ করেছ। পরে একটি মেয়ের কথা উঠিল। মা বলিলেন, “দেখ না, মা, শ্বশুরঘর করবে না, আমার কাছে এসেছে। জামাই কাল�ো বলে মনে ধরেনি। কাল�ো বলে কি তুই তাকে নিবি নে? সে ত�োর স্বামী। এ সব কি রকম মেয়ে মা, তা জানি নে। আবার শুনি তার স্বভাব খারাপ; সেইজন্যেও যেতে চায় না। তাহলেই বা, ত�োকে ত�ো অযত্ন করেনি। স্বামী ত�ো বটে। কি জানি মা, এ সব মেয়ে কি রকম! ল�োকে শুনলে ভাববে কি? যা মন চায় করুকগে।” ইহা বলিয়া তিনি কাপড় কাচিতে গেলেন। বিদায় লইবার সময় আমরা প্রণাম করিয়া বলিলাম, ‘যাই, মা।’ মা বলিলেন, “ ‘যাই’ বলতে নেই, ‘আসি’ বলতে হয়। সময় পেলেই আবার এস�ো, মা।” —(শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩০৩-৩০৪) সাংসারিক জীবনের একটি ঝামেলা তুলে ধরে শ্রীমা তা নিরসনের পথ দেখিয়েছেন। সুধীরাদিদি নিবেদিতা স্কুলে থাকে। ১৭৩

স্কুল ছুটির পর শ্রীমায়ের কাছে এসেছে। শ্রীমা প্রসঙ্গক্রমে একটি মেয়ের মানিসকতার কথা বলেছেন যা এখন একটি সামাজিক ব্যাধি। কাল�ো স্বামীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে বলে, ঐ মেয়েটীর স্বামীকে পছন্দ হয়নি। আবার বলেছে, তার স্বভাব চরিত্র ভাল নয়। কিন্তু মায়ের বক্তব্য—েস ত�ো তার ক�োন অবহেলা করেনি। স্বামী যাই হ�োক, তাকে মানিয়ে নিয়েই ঘরকন্না করার প্রথা। সংসারের সুখ শান্তি বজায় থাকে স্বামীস্ত্রীর পারস্পরিক েবাঝাপড়ায়। একের আনন্দ অন্যের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালে তা তাদেরই আলোচনার মধ্য দিয়ে মিটিয়ে নিতে হয়। ঘরের কথা, ঘরেই থাকা ভাল। অন্য বাইরের পাঁচজন না জানলেই তা সুখের হয়। ল�োকের ‘ছিঃ ছিঃ’ শ�োনার যন্ত্রণা থেকে এই ভাল৷ এবার শ্রীমায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ‘যাই’ বলে যেতে চাইলে শ্রীমা সংশ�োধন করে বলেছেন ‘যাই’ বলতে নেই ‘আসি’ বলতে হয়। ক�োন রকমের ত্রুটি তাঁর চ�োখ এড়াতো না৷ তিনি তা সঙ্গে সঙ্গে সুধরে দিতেন। এ হেন মাতৃপরশের অনুভতি ূ , অন্তর রাজ্যের বিরুদ্ধ অবস্থার পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা নেয়।

১৭৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

অষ্টাশি “আহারান্তে মা সুধীরা দিদিকে হাতেমাখা প্রসাদ দিলেন। আমাদের মধ্যে দুইজন বিধবা। তাহারা সেই প্রসাদ খাইতে একটু ইতস্ততঃ করাতে মা বলিলেন, “প্রসাদে দ�োষ নেই, ত�োমরা খাও, মা।” তারপর মা একটু শুইলেন এবং আমাদের মেজেয় মাদুর পাতিয়া শুইতে বলিলেন। বৈকালে মা ঠাকুর তুলিয়া আমাদের প্রসাদ দিলেন এবং বারান্দায় বসিয়া সুধীরা দিদির সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। একটি বউ একখানি কার্পেটের তৈয়ারি গ�োপালের ছবি মায়ের হাতে দিয়া প্রণাম করিয়া বসিল। সেখানি দেখিয়া মা বলিলেন, “বউমা, তুমি এখানি করেছ?” বউ বলিল, ‘হ্যাঁ, মা।’ মা বলিলেন, “আহা, বেশ হয়েছে। কি সুন্দর মুখের ভাব! কেমন করেছে দেখ।” বলিয়া আমাদের সকলকে দেখাইতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “বেশ হয়েছে, না?” আমরা বলিলাম, ‘হাঁ।’ তিনি সেখানি আবার দেখিয়া মাথায় স্পর্শ করিয়া তুলিয়া রাখিতে বলিলেন এবং পরে বউটির বাড়ির কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া তাহাকে প্রসাদ দেওয়াইলেন।” —(শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩০৫-৩০৬) ১৭৫

শ্রীমা নিজে হাতে মাখা প্রসাদ সুধীরাদিদিকে দিয়েছিলেন৷ সঙ্গের দুই বিধবাও সেই প্রসাদ খাবে কি না এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হলে তিনি বললেন, ‘প্রসাদে দ�োষ নাই’; সর্বাবস্থায় যে ক�োন প্রসাদ ধারণ করা যায়। প্রসাদ ধারণের ক�োন বিশেষ বিধিনিষেধ নাই। শ্রীমায়ের কাছে যে যখন এসেছে, সে তখনই প্রসাদ পেয়েছে। জয়রামবাটি থেকে শুরু করে উদ্বোধনের মায়ের বাড়ি সর্বত্রই শ্রীমায়ের প্রসাদ বিতরণ সমানভাবে চলেছে। প্রসাদে সর্বদুঃখের বিনাশ হয়। জনৈক ব�ৌমা কার্পেটের তৈরি একটি গ�োপালের ছবি শ্রীমাকে দিয়েছে। শ্রীমা তা দেখে বালিকার মত�ো খুশি। সবাইকে তা দেখাচ্ছেন এবং তার প্রশংসা করে চলেছেন। কারও মধ্যে একটু বিশেষ গুণ দেখলেই তাকে শতগুণে বর্ধিত করে, তার অন্তর্নিহিত দৈবীসত্তার স্ফূরণে সাহায্য করেন, ঐ পথে এগিয়ে দিয়ে থাকেন। কারও প্রশংসা করলে তার মনের দৃঢ়তা বাড়ে, সাহস হয় এবং যেক�োন বিপরীত পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মায়। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকের মধ্যে যে অনন্ত শক্তি রয়েছে তা বুঝতে পারে। শ্রীমা এইভাবেই ছ�োট ছ�োট কাজের মধ্য দিয়েও সকলো সার্বিক মঙ্গল করে গিয়েছেন এবং তাদের একান্ত আপন করে নিয়েছেন। ১৭৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

উননব্বই “একদিন বেলা তিনটার সময় মা বৃদ্ধাদের আশ্রম দেখিতে যাইবার পথে আমাদের তুলিয়া লইয়া গেলেন। সেখানে নামিতেই একটি বউ আসিয়া মাকে উপরে লইয়া গেলেন। বৃদ্ধারা সকলে মায়ের চরণে ফুল দিয়া প্রণাম করিতে লাগিলেন। মা—একি গ�ো? এরা সব কাশীবাসী, এরা আবার প্রণাম করে কেন? বউ—তা করবে না, মা? আপনার অন্নে এরা প্রতিপালিত। মা—বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণাই আছেন, মা। তুমি বুঝি এদের দেখাশুনা কর? বউ—হ্যাঁ মা, যেমন করান। মা—আহা, তা বেশ। এই অনাথা বুড়িদের সেবা করলে নারায়ণের সেবা করা হয়। আহা, এই সব ছেলেরা কি কাজই করেছে! তারপর মা বৃদ্ধাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া এবং তাহাদের ঘরগুলি দেখিয়া ফিরিয়া আসিলেন।” —(শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩১৩)

শ্রীমা কাশীতে এক বৃদ্ধাবাসে গিয়েছেন। সেখানকার বৃদ্ধা আবাসিকেরা তাঁকে প্রণাম করলে তাঁর জিজ্ঞাসা এরা কেন তাঁকে প্রণাম করছে? জানা েগল তাদের িবশ্বাস শ্রীমা-ই অন্নপূর্ণা; তাঁর প্রদত্ত অন্নেই তাদের জীবন ধারণ। শ্রীমা তাদের থাকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থান দর্শন করে বড়ই আনন্দিতা। অনাথা বুড়িদের সেবা করলে নারায়ণের সেবা করা হয়। যেখানে যে সেবা প্রয়োজন হয়, সেখানে সেটিতেই ঠিক ঠিক ‘সেবা’ সম্পন্ন হয়। যার অর্থের প্রয়োজন, তাকে অর্থ দিয়ে; যার ওষুধের প্রয়োজন তাকে ওষুধ দিয়ে; আবার যার অবলম্বনের দরকার, তাকে তা দিয়ে সেবাই প্রকৃষ্ট সেবা। কাশীধামে বৃদ্ধাদের ‘বৃদ্ধের যষ্টি’ প্রয়োজন৷ স্বামীজীর ‘নারায়ণ জ্ঞানে নরের সেবা’ এইভাবে করা হয়ে থাকে। শ্রীমা তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনে সমব্যথী হয়েছেন; সুপরামর্শ দিয়েছেন। শ্রীমায়ের অপার স্নেহসুধায় ধন্য হয়েছে তাদের কাশীবাস৷ কাশীবাসে মা-অন্নপূর্ণা স্বয়ং যেন মা-সারদার রূপে তাদের সার্বিক মঙ্গল সাধন করেছেন৷

১৭৭

১৭৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

নব্বই “য�োগেন-মার কাছে ঐ কথা শুনিয়া মা গাড়ি করিয়া কলিকাতায় গিয়া ঠাকুরের কাছে কাঁদিয়া বলেন, “তুমি নাকি আমার উপর রাগ করে চলে এসেছ?” ঠাকুর বলিলেন, “না, কে ত�োমায় এ কথা বলেছে?” মা বলিলেন, ‘গ�োলাপ বলেছে।’ তখন ঠাকুর রাগিয়া গিয়া বলিলেন, “হাঁ! সে এমন কথা বলে ত�োমায় কাঁদিয়েছে? সে জানে না তুমি কে? গ�োলাপ ক�োথায়? আসুক না?” মা তখন শান্ত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে চলিয়া গেলেন। পরে গ�োলাপ-মা ঠাকুরের কাছে আসিলে ঠাকুর তাঁহাকে খুব ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি কি কথা বলে ওকে কাঁদিয়েছ? জান না ও কে? এক্ষুণি গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাওগে।” গ�োলাপ-মা তখনই হাঁটিয়া দক্ষিণেশ্বরে মায়ের কাছে কাঁদিতে কাঁদিতে গিয়া বলেন, “মা, ঠাকুর আমার উপর ভয়ানক রাগ করেছেন। আমি না বুঝতে পেরে অমন কথা বলে ফেলেছি।” মা ক�োন কথা না বলিয়া খালি হাসিয়া, “ও গ�োলাপ, ও গ�োলাপ” বলিয়া পিঠে তিনটি চাপড় দিতেই গ�োলাপ-মার সব দুঃখ যেন ক�োথায় চলিয়া গিয়া মন শান্ত হইয়া গেল। এই ঘটনাটি গ�োলাপ-মা নিজে আমার কাছে বলিয়াছিলেন।

—(শ্রীমতী সরলাদেবী, পৃঃ ৩১৭) গ�োলাপ-মা বলেছে, শ্রীমায়ের উপর রাগ করে সম্ভবত ঠাকুর কলকাতায় চলে গিয়েছেন। একথা শুনে শ্রীমা কলকাতায় গিয়ে ঠাকুরকে তার সত্যতা জিজ্ঞাসা করেছেন। শ্রীমায়ের কষ্ট হয়েছে দেখে ঠাকুর গ�োলাপ-মার উপর রেগে গিয়েছেন। ঠাকুরের সঙ্গে গ�োলাপ-মার দেখা হলে, তিনি তাকে বকেছেন এবং শ্রীমায়ের স্বরূপও জানিয়েছেন। গ�োলাপ-মা ভয় পেয়ে শ্রীমায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থীণী হয়ে এসেছেন। শ্রীমা ‘ও গ�োলাপ’ ‘ও গ�োলাপ’ বলে তার পিঠে তিনটি চাপড় দিতেই তার সব দুঃখ দূর হয়েছে। সমাল�োচনা করা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রকৃত সত্য জানার পর তা থেকে যে শ�োক বা আত্মগ্লানি আসে তা অপন�োদনের এই প্রয়োগ ক�ৌশলটি সবাই জানে না৷ অজ্ঞানতাবসত ভুলভ্রান্তি করে ফেললেও ভগবান এভাবেই ভক্তের ক্ষোভ নিরসন করে থাকেন এবং আনন্দ সাগরে নিমজ্জিত করেন। অবশ্য সেজন্য গ�োলাপ-মার মত সেবা ভাবটীও দরকার। গ�োলাপ-মা শ্রীমাকে সর্বত�োভাবে গিন্নির মত�ো রক্ষা করেছেন। গ�োলাপ-মা সব সময় পাগল ভক্তদের জ্বালাতন থেকে শ্রীমাকে আগলে রেখেছিলেন। শ্রীমাও কোন সমস্যায় পড়লে এই গ�োলাপ-মারই দারস্থ হতেন।

১৭৯

১৮০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একানব্বই “একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ভাবে আমি সাধনভজন করব?” মা বলিলেন, “ঠাকুরকে ডাকলেই সব হবে। ইহা আমার মনঃপূত না হওয়ায় আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম। মা তখন বিরক্ত হইয়া জ�োর গলায় বলিলেন, “আমি আর কিছু জানি নে; ঠাকুরের কাছে যা চাইবে তাই পাবে।” ক�োয়ালপাড়ায় একদিন একটি পাগল আসিয়া বাড়ির বাহিরে পাগলামি করিতেছিল। মা উহার কাণ্ড দেখিয়া বলিলেন, “দেখ না, যত সব পাগলের মেলা। আমরা এসেছি কিনা, তাই যত সব পাগল আসছে। দেখ, রাধু পাগল, তার মা পাগল, এই সব নিয়ে আমার ঘর।” এই কথা বলিয়া একটু চুপ করিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন, “ঘরে আসবে চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী, আসবে কত দণ্ডী, য�োগী, জটাধারী।” —(স্বামী ঋতানন্দ, পৃঃ ৩২৯) শ্রীমায়ের কাছে সাধন পদ্ধতি জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, ঠাকুরকে ডাকলেই হবে৷ কি সহজ ও সুন্দর কথাটি৷ কিন্তু ভক্তমনের বাসনা অনেক কিছু করতে হবে, তবেই ঠাকুর দর্শন দেবেন৷ তাই ঐ সামান্য কথাতে মন না ভরায় আবারও েসই একই কথা জিজ্ঞাসায় শ্রীমা অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছেন, ‘আমি আর কিছু জানি নে; ঠাকুরের কাছে যা চাইবে তাই পাবে।’ ১৮১

ঠাকুেরর কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায় বটে কিন্তু চাইতেও জানতে হয়৷ চন্দ্রমোহন দত্তের মতো না হয়ে দাঁড়ায়—‘মা প্রসাদ দাও’ বলে চলে আসা৷ আবার স্বামীজীর মতো নয়, ‘জ্ঞান দাও, বিবেক দাও, ৈবরাগ্য দাও’ বলে ভাত কাপড়ের অভাব না জানাতে পারা৷ অন্য এক প্রসঙ্গে, শ্রীমা তাঁর স্বরূপের আভাস দিয়েছেন—েকায়ালপাড়ায় একটি পাগল এসে বাড়ির বাইরে পাগলামি করছে৷ শ্রীমা তার কাণ্ড দেখে বললেন, ‘আমরা এসেছি কিনা, তাই যত সব পাগল আসছে। দেখ, রাধু পাগল, তার মা পাগল, এই সব নিয়ে আমার ঘর।’ আসলে তিনি েতা পাগল ভোলার ঘরণী৷ তাই এও বলেছেন ‘ঘরে আসবে চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী, আসবে কত দণ্ডী, য�োগী, জটাধারী’। সত্যই কত সব যোগী সাধুর আগমন হয়েছিল, আবার ওদিকে যেমন কিনা ঠাকুর-জননী ঠাকুরের আবির্ভাবের পূর্বে রোদে পোড়া হাঁসেচড়া লালমুখ ঠাকুরের দর্শন েপয়েছিলে৷

১৮২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

বিরানব্বই “মা—টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুলতলায় বাস। ক�োথায় সংসার ছেড়ে এসে ভগবানের নাম করবে, না কেবল কাজ! আশ্রম হল�ো দ্বিতীয় সংসার। ল�োকে সংসার ছেড়ে আশ্রমে আসে, কিন্তু এমন ম�োহ ধরে যায় যে আশ্রম ছেড়ে যেতে চায় না। ত�োমার শরীর ভাল নয়, তুমি ডহরকুণ্ডুতে যাও; যতটা পার ছেলে পড়াবে আর ধ্যানভজন করবে। আমি—মা, আমার ইচ্ছা ক�োন জায়গায় গিয়ে সাধনভজন করি, কিন্তু শরীর ভাল নয়। মা—এখন কিছুকাল সামান্য কাজ নিয়ে থাক; যখন মনে প্রবল ইচ্ছা হবে তখন যেও। আমি—জপ ত�ো করি, কিন্তু মন বসে না। মা—মন বসুক না বসুক, জপ করবে। র�োজ যদি এত (সংখ্যা) করে জপ করতে পার ত�ো ভাল হয়।” —(স্বামী তন্ময়ানন্দ, পৃঃ ৩৩২) সাধু-জীবনের কি সুন্দর বাস্তব বর্ণনা দিয়েছেন শ্রীমা৷ ভগবােনর নাম করবে বলে সংসার ছেড়ে আশ্রমে এসে েসই আশ্রমে কাজের মোহে পড়ে আর অাশ্রম ছেড়ে বের ১৮৩

হতে পারে না৷ সাধন-ভজনের জন্য এই েমাহও কাটাতে হবে৷ এ মোহও এক ধরণের মায়াবন্ধন বা আসক্তি বলা যে​েত পারে৷ আমি না হলে এ কাজ কে করবে, বা আমার মতো করে কেউ করতে পারবে না ইত্যািদ৷ ঠাকুরের সঙ্ঘ, তিনি ঠিক চালিয়ে নেবেন৷ আমাকে তাঁর হাতের যন্ত্র করে তাঁরই কাজ করিয়ে নিচ্ছেন, ধন্য আমি—এমন ভাবনা হলে আসক্তি হয় না৷ যতক্ষণ দায়িত্ব থাকবে, প্রাণপণে শুধু তা পালন করতে হবে৷ জপ তপের প্রসঙ্গে শ্রীমা বলেছেন, মন বসুক বা না বসুক প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক জপ করতে হবে৷ আলস্য বা অনিচ্ছা আসা স্বাভাবিক, তাকে কািটয়ে উঠতে হবে৷ শরীর ভাল বা মন্দ সব অবস্থায়ই থাকবে৷ সব দিন একরকম মন বা শরীর থাকবে না৷ তবুও নিত্য নিয়মিত জপ-ধ্যান করে যেতে হবে৷ তাহলে একদিন এমন হবে—এটি না করলে মন ভাল থাকবে না৷ অভ্যাসে এটিকে রপ্ত করতে হবে৷ ভগবানের নামের আকর্ষণী শক্তি ভক্তকে িঠক আকর্ষণ করবেই৷ ১৮৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

তিরানব্বই “বরিশালে ফিরিবার পূর্বে মাকে প্রণাম করিতে যাই। মা বলিলেন, “সাবধানে যেও। পথে বিপদাদি থেকে ঠাকুর ত�োমাদের রক্ষা করবেন।” রাস্তায় ভয়ানক ঝড় উঠায় প্রাণসংশয় হইল। বাড়ি পৌঁছিয়া আমাদের সকলেরই ধারণা হইল যে মায়ের আশীর্বাদেই আমরা সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছি। ইহার এক বত্সর পরে বৈশাখ মাসে জয়রামবাটীতে মাকে পুনরায় দর্শন করি। এইবারই তাঁহার সহিত খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার সুয�োগ পাইয়াছিলাম। মা সামনে বসিয়া আদর করিয়া খাওয়াইতেন, আর আমি আনন্দে আত্মহারা হইয়া যাইতাম। মায়ের কাছে থাকিয়া ধ্যানজপ করিলে বেশি ফল হইবে মনে করিয়া জয়রামবাটীতে একদিন খুব ধ্যানজপ চালাইলাম। ঐদিন প্রণাম করিবার সময় মা বলিলেন, “মায়ের কাছে এসেছ, এখন এত ধ্যানজপের কি দরকার? আমিই যে ত�োমাদের জন্যে সব করছি। এখন খাও দাও, নিশ্চিন্তমনে আনন্দ কর।” —(শ্রীমহেন্দ্র গুপ্ত, পৃঃ ৩৩৪) শুভানুধ্যায়ীদের আশীর্বাদেও অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। শ্রীমায়ের কাছে ভক্ত বিদায় নেওয়ার সময়

সাবধানে যাওয়ার জন্য নির্দেশ পেয়েছিলেন। তাই পথের বাধা দূর হয়েছে। তাদের ধারণা শ্রীমায়ের কৃপায় এ যাত্রায় মঙ্গল হয়েছে। এক বছর পরে তারা জয়রামবাটিতে মাতৃসকাশে উপস্থিত। শ্রীমা তাদের আদর-যত্ন করে সামনে বসে থেকে খাইয়েছেন। শ্রীমায়ের কাছে থেকে জপ ধ্যান করলে অনেক বেশি ফল পাওয়া যায়—এ বিশ্বাসে বেশি বেিশ মন�োনিবেশ করায় শ্রীমা বলেন, ‘বাবা, খাও, দাও, আনন্দ কর’। তঁার কাছে এসেছে জপ ধ্যানের কি দরকার আছে। আসলে শ্রীমা চাইছেন, তাঁর সন্তানেরা তাঁর ওপর নির্ভর করে জগতের দুঃখ থেকে দূরে থাকুক। শ্রীমায়ের জপ না করে আনন্দে সময় অতিবাহিত করতে বলেছেন। সাক্ষাৎ বিশ্বজননী চ�োখের সামনে রয়েছেন, তাই নাক টিপে তাঁর জাগরণ করা হাস্যকর৷ বিশ্বাস আর ভালবাসা থাকলে শ্রীমা যা করতে বলেছেন তাই করতে হয়। তাঁর উপস্থিতিেত সব দুঃখের নাশ হয়ে আনন্দে বিরাজ করা যায়; হৃৎপদ্ম বিকশিত হয়ে ওঠে। তিনি সব দিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু তা গ্রহণ করতে না পারায় এই দুঃখ, তিনি ধরা দিচ্ছেন কিন্তু ভক্ত ধরতে পারছে না। এ জন্যই সাধনায় প্রস্তুত হতে হয়৷

১৮৫

১৮৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

চুরানব্বই “রামবাবুর সহিত কথাবার্তা শেষ হইলে মা আমাকে ঠাকুরঘরে ডাকিলেন ও বলিলেন, “খাওনি কেন? প্রসাদ, খেয়ে ফেল।” জনৈক স্ত্রী-ভক্ত আসিয়া বলিলেন, “সব মিষ্টিগুলি সকলকে খাইয়ে দিলে, মা, আমরা খাব কি?” আমি ত�ো সঙ্কুচিত, কারণ তখনও আমার হাতে রসগ�োল্লা দুটি রহিয়াছে। বলিলাম, “আপনি এই দুটি খান।” তিনি বলিলেন, “না, মা, ত�োমাকে কিছু বলিনি, ত�োমারটি নেব কেন?” মা তাঁহাকে বলিলেন, “ও—এসব বল�ো না, ভক্তদের মনে কষ্ট হবে। বহু ল�োক, দুটি করেও কুল�োয়নি। আহা ওরা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এসেছে গ�ো।” মা আমাকে বার বার খাইতে বলায় খাইয়া ফেলিলাম। মা নিজেই জল আনিয়া দিলেন, পরে বলিলেন, “রসগ�োল্লার রস মেজেয় পড়েছে, ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেল, হাত ধ�োও।” —(শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, পৃঃ ৩৩৭) শ্রীমা এক মহিলা ভক্তকে প্রসাদ দিয়েছেন, সে তা না খেয়ে হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীমা না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলে অপর এক মহিলা ভক্ত শ্রীমায়ের কাছে অনুয�োগ করে, সব মিষ্টি প্রসাদ িহসাবে অন্যদের দিয়ে ১৮৭

দিলে তারা কি খাবে? বহুদূর থেকে আগত ভক্তদেরকে প্রসাদ দেওয়ায় তারা তা ভক্তি-শ্রদ্ধায় গ্রহণ করে তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু যারা প্রত্যহ প্রসাদ পায়, তারা কি আর সেই প্রসাদের মাধুর্য অনুভব করে? তারা প্রসাদকে খাদ্যবস্তু জ্ঞানে খেয়ে থাকে। অন্তর্যামিনী শ্রীমা তা বোঝেন৷ প্রসাদ দেওয়া তার স্বভাব, তিনি কাকে কি দিতে হবে আর না দিতে হবে তা ভাল করেই ব�োঝেন। তাই এসব সামান্য ব্যাপারে মন না দিয়ে পূর্বের ভক্ত মহিলাকে খেতে বলেন। রসগ�োল্লার রস মেঝেতে পড়াতে তা পরিষ্কার করেও নিতে বলেন। এক ধরনের মানুষ থাকে যারা শুধু নিজেদের দিকেই নজর রেখে অন্যরা প্রসাদ পেল কি পেল না তা দেখে না। নিজেদের হলেই হল�ো। প্রসাদ কণিকা মাত্র ধারণে আত্মপ্রসাদে বা মানসিক তৃপ্তি লাভ হয়ে থাকে। যদিও আত্মপ্রসাদে পরিতৃপ্ত ভক্তের সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রকৃত ভক্ত আত্মপ্রসাদেই পরিতৃপ্তি লাভ করে থাকে। আবার শ্রীমায়ের হাতের প্রসাদ হলে ত�ো কথাই নেই। সর্বক্ষেত্রে এরকম মানসিকতায় নিজের সন্তুষ্টি লাভ করতে হয়। ১৮৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

পঁচানব্বই “লক্ষ্মী দিদি পান লইয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ধন্য মেয়ে তুমি, মা যেচে কৃপা দিলেন; ধর একটি পান খাও।” আমি চ�োখের জলে পান দেখিতে পাইলাম না। মা পানটি আনিয়া আমাকে দিয়া বলিলেন, “ঐ মাদুরখানা মেজেয় পাত, ঐ শতরঞ্চিখানা বিছিয়ে দাও, বালিস তিনটি দাও।” বিছানা হইলে মা শুইয়া পড়িলেন। আমি বসিয়া মায়ের পায়ে হাত বুলাইতেই মা বলিলেন, “এখন আমার পাশে শুয়ে পড়।” আমি সঙ্কুচিতা হইতেছি দেখিয়া মা বলিলেন, “আমার বালিশেই মাথা রেখে শ�োও।” আমি বলিলাম, “না, মা, ঘুমিয়ে পড়লে আপনার গায়ে পা লাগতে পারে, আমি শ�োব না।” মা বলিলেন, “সেকি গ�ো? আমি বলছি, তুমি শুয়ে পড়।” কি করি মায়ের আদেশই পালন করিতে হইল। মা বলিলেন, “ত�োমাকে দেখে বড়ই আনন্দ হল�ো, যেমন অনেকদিন পরে শ্বশুরঘর থেকে মেয়ে এলে মায়ের আনন্দ হয়। আচ্ছা, কবে যাবে?” —(শ্রীমতী সুশীলা মজুমদার, পৃঃ ৩৪২-৩৪৩) মহিলাটি ভাগ্যবতী কারণ তার দীক্ষা হয়েছে শ্রীমায়ের কাছে। লক্ষ্মী দিদি তাকে আবার পান দিয়েছেন। আনন্দে তার

চ�োখে জল এসেছে, তাই সে পান দেখতে পাচ্ছে না। সে নিজেকে ভিখারিণী ভেবেছে। শ্রীমায়ের দুয়ারে সবাই তাই। শ্রীমা তিনটি বালিশ ও মাদুরেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছেন। দীক্ষিত মহিলাটি শ্রীমায়ের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে শ্রীমা তাকে তারই পাশে শ�োয়ার জন্য বলেছেন। সে নারাজ হচ্ছে। বলে, ঘুমের ঘ�োরে তাঁর গায়ে পা লেগে যেতে পারে। শ্রীমা ক�োন কথা না শুনে অতি আপন করে বলেন, তারই বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়তে। আদেশ শির�োধার্য। আটপ�ৌরে ঘর�োয়া কথাবার্তা চলতে লাগল। এরকম করেই শ্রীমা সবাইকে আপন করে নিতেন। শুভ সংস্কার তিনি বুঝতে পেরে সেই ভাবে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করতেন। মনের কার কি গতি তা বুঝতে পারতেন এবং সেই ভাবে তাদের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে দিতেন। অহমিকা না হলে এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকলে তার সৎ ব্যবহার করতেন। জমি প্রস্তুত হলে৷ বীজ র�োপনের উপযুক্ত আল�োবাতাস পেলেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ধীরে ধীরে বিশাল বৃক্ষের রূপ নিতে পারে, আধ্যাত্মিক জীবনও অনুরূপভাবে পুষ্ট হয়ে থাকে।

১৮৯

১৯০


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

ছিয়ানব্বই “জনৈক সাধু ৺কাশীতে মণিকর্ণিকায় খুব তপস্যা করিতেছিলেন। আমি কলিকাতা আসিবার সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “মাকে জিজ্ঞাসা কর�ো কতদিনে ভগবানের কৃপা আমার উপর হবে।” আমি মাকে ঐ কথা বলায় মা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “তাকে লিখে দাও যে, তপস্যা করছ বলেই যে ভগবানের কৃপা হবে, এমন নয়। আগে ঋষিরা ঊর্ধ্বপদে হেঁটমুণ্ড হয়ে নিচে আগুন জ্বেলে হাজার হাজার বছর কত তপস্যা করত! তাতে কখন�ো কারও উপর কৃপা হত�ো, কখন�ো বা হত�ো না। সবই তাঁর দয়ার উপর নির্ভর করে।” একবার ঠাকুরের সময়ে জনৈক বিশিষ্ট গৃহস্থ ভক্তের সহিত আমার কাশী যাইবার কথা উঠে। তাহাতে আমার পাথেয় খরচ তিনিই বহন করিতেন। মা শুনিয়া আমায় বলিলেন, “তুমি সাধু, ত�োমার কি আর যাওয়ার ভাড়া জুটবে না? ওরা গৃহস্থ, ওদের সঙ্গে কেন যাবে? এক গাড়িতে যাচ্ছ; হয়ত�ো বললে, ‘এটা কর, ওটা কর।’ তুমি সন্ন্যাসী, তুমি কেন সে-সব করতে যাবে?” —(স্বামী শান্তানন্দ, পৃঃ ৩৪৫)

সাধু সন্ন্যাসীগণ তপস্যা করে কখন ভগবানলাভ হবে, কবে তঁার দর্শন পাওয়া যাবে—এ সব নিয়ে শ্রীমাকে পত্রে জানতে চাইলে, তিনি অসন্তুষ্ট হতেন৷ তাঁর মতে— ভগবানের যখন ইচ্ছা হবে, তখন তিনি কৃপা করবেন৷ একটু জপ তপ করলেই যে ভগবান কাছে এসে দেখা দেবেন, এমন কোন নিয়ম নেই৷ ঊর্ধপাদ হেটঁমুণ্ড হয়ে ঋষিরা যুগ যুগ ধরে কঠিন তপস্যা করেও তঁার দর্শন পান নি৷ সময় হলে, তিনি অবশ্যই করুণা করবেন৷ শুধুমাত্র যার যা কর্ম তা নিষ্ঠা ভরে করে যেতে হবে৷ সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের মধ্যে কিরূপ ব্যাবহািরক সম্পর্ক হবে তা সুন্দরভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে েচাখের সামনে তুলে ধরেছেন৷ সাধু তীর্থে যাবেন িবশিষ্ট ভক্তের সঙ্গে৷ ভক্ত সাধুর পাথেয় দিয়ে সাহায্য করবেন৷ কিন্তু শ্রীমায়ের ভবিষ্যত সঙ্ঘের সন্ন্যাসী ও গৃহস্থ ভক্তদের উদ্দেশ্য করেই যেন সাবধান করে দিয়েছেন—সন্ন্যাসীকে হয়তো গৃহীভক্ত ‘এটা কর, ওটা কর’ বলতে পারেন৷ এভাবে গৃহস্থ অজ্ঞানবশতঃ েকান অন্যায় করে ফেললে নিজের অমঙ্গল হতে পারে৷ তাই সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের সার্বিক মঙ্গলের জন্যই এই পরামর্শ দান৷

১৯১

১৯২


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

সাতানব্বই “এক সময়ে একটি ভক্ত মাকে বলিয়াছিল, “মা, আমি বড় গরিব। ইচ্ছা হয়, যখন-তখন আপনার দর্শনে আসি। কিন্তু আপনার জন্য ইচ্ছামত কিছু আনতে পারিনে বলে সব সময় আসতে পারিনে।” শুনিয়া করুণাময়ী স্নেহবাক্যে বলিলেন, “বাবা, যখন আসবার ইচ্ছা হবে, একটা হরীতকী হাতে করে এস�ো।” জনৈক ভক্ত মাকে দর্শন করিতে গিয়াছেন। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আমার কাছে দীক্ষিত?” ভক্ত বলিলেন, “হাঁ, মা। মা, আমি বড় সংসারী। নিজে বিবাহ করিনি, কিন্তু ভাইয়ের মেয়ের দ্বিরাগমন ইত্যাদি নিয়ে আছি। আমার কি হবে, মা?” মা বলিলেন, ‘দেখি।’ ইহা বলিয়া বক্ষ স্পর্শ করিবার জন্য হাত বাড়াইলেন। ভক্তটি তাড়াতাড়ি ক�োটের ব�োতাম খুলিতেছেন। কিছুদূর হাত লইয়া মা বলিলেন, “থাক, থাক, আর খ�োলবার দরকার নেই। ত�োমার ত�ো হবে। না হলে আমার হাত ওদিকে যেত না!” —(শ্রী, পৃঃ ৩৪৮)

শ্রীমায়ের দীক্ষিত সন্তান গরিব বলে প্রণামী ছাড়া ঘন ঘন মাতৃদর্শনে আসতে পারে না। শ্রীমা তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন—মনের গভীরে মাতৃদর্শনের প্রবল বাসনা এবং সান্নিধ্যসুখের প্রত্যাশী কিন্তু আর্থিক অনটনের দরুন তা হতে বঞ্চিতা। তাই একটা হরিতকী হাতে নিয়ে আসতে বলেছেন। আরেক ভক্ত বিবাহ না করেও নিজেকে ঘ�োর সংসারী ভাবছে, কারণ তার ভাইয়ের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আসলে েস সংসার না করেও সাংসারিক কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। শ্রীমা তার বক্ষ স্পর্শে উদ্যত হলে সে তাড়াতাড়ি জামার ব�োতাম খুলতে শুরু করেছে। হৃদয় পদ্মের অবস্থান ভেতর থেকে বুঝলেও ভক্তের মনস্তুষ্টির জন্য শ্রীমা ঐ বাহ্যাচারণ দেখিয়েছেন৷ শেষে আশ্বাস দিয়ে তাকে উৎসাহিত করেছেন। শ্রীমা বলেছেন, ঠাকুরের দেওয়া জিনিসই তিনি দিয়ে থাকেন। তাঁর স্পর্শেই জীবের মুক্তি ‘করফলায়তে’ হয়ে যায়। মাতৃদর্শনেই মানুষের ললাটলেখন পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবে যার যেমন সংস্কার, সে তেমন চেয়ে বসে। কয় জনাই আর মুক্তি প্রত্যাশী হয়?

১৯৩

১৯৪


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

আটানব্বই “জনৈক ভক্ত মাকে জিজ্ঞাসা করেন, “ঠাকুর বলেছেন, ‘এখানে যারা আসবে তাদের শেষ জন্ম।’ আবার স্বামীজী বলেছেন, ‘সন্ন্যাস না হলে কারও মুক্তি নেই।’ গৃহীদের তবে উপায়?” মা তদুত্তরে বলিলেন, “হাঁ, ঠাকুর যা বলেছেন তাও ঠিক, আবার স্বামীজী যা বলেছেন তাও ঠিক। গৃহীদের বহিঃ-সন্ন্যাসের দরকার নেই, তাদের অন্তঃসন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তবে বহিঃ-সন্ন্যাস আবার কারও কারও দরকার। ত�োমাদের ভয় কি? তাঁর শরণাগত হয়ে থাকবে, আর সর্বদা জানবে যে ঠাকুর ত�োমার পেছনে আছেন।” ১৯১০ সালে জয়রামবাটীতে সাধনভজন-প্রসঙ্গে মা জনৈক ত্যাগী ভক্তকে বলিয়াছিলেন, “সকাল-সন্ধ্যায় বসবে। আর মাথা ঠাণ্ডা রেখে জপধ্যান করবে। এর চেয়ে মাটিক�োপান স�োজা কাজ।” ঠাকুরের ছবির দিকে দেখাইয়া বলিলেন, “ওঁর কৃপা না হলে কিছুই হবে না।” আশ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য নিয়মিত জপধ্যানে বিঘ্ন ঘটিতে পারে, এই কথা বলায় মা বলিলেন, “কাজ আর কার? কাজ ত�ো তাঁরই।” ১৯৫

—(শ্রী, পৃঃ ৩৫১) ঠাকুর এবং স্বামীজীর দুটি কথা ‘যারা এখানে আসবে তাদের শেষ জন্ম’ এবং ‘সন্ন্যাস না হলে মুক্তি নেই’— শ্রীমা বলেছেন, দুট�োই ঠিক। তাহলে গৃহস্থদের উপায় কি? অন্তর্সন্ন্যাস নিয়ে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে অনুভব করতে হয় ঠাকুর রয়েছেন। আবার ত্যাগী ভক্তরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে জপধ্যান করবে। ধ্যান জপ অপেক্ষা মাটি ক�োপান�ো সহজ। তবে ঠাকুরের কৃপা হলে সব অসম্ভবই সম্ভব হয়। কাজের জন্য জপধ্যানে ব্যাঘাত হয় শুনে শ্রীমা বলেছেন, সব কাজই ত�ো ঠাকুরের কাজ। আসলে ম�োড় ফিরিয়ে দিতে হয়। ঠাকুরের চিন্তনই ত�ো ধ্যানের নামান্তর। আমরা কাজ করার সময় এই ঈশ্বরীয় ভাবনাটি আনতে পারি নাই বলেই লক্ষ্য চ্যুতি হয়ে থাকে। ঠাকুরকে ভুলে তার কাজের নামে নিজের অহমিকা প্রকাশ করে ফেলি। বাগান কে করেছে ?আমি৷ গরু কে মেরেছে? ইন্দ্র—এভাবে হয় না৷ দ্বিচারিতা বন্ধ করে মন মুখ এক করতে হয়৷ তাই চ�োখ বন্ধ থাকলেও ঠাকুর, আবার চ�োখ খ�োলা থাকলেও তিনি। কাজ করতে করতে শেষে শুদ্ধমনই গুরু হয়ে যায়। ১৯৬


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

নিরানব্বই “মা বলিলেন, “ঐ দেখ কমণ্ডলুতে ঐ সব রয়েছে; সবটা হাত এতে ডুবিয়ে দাও।” তাহাই করিলাম। বলিলেন, “আর হাতে অসুখ থাকবে না। তবে মাছ-মাংস, রসুন-পেয়াজে হাত না দিয়ে যতদূর পার থেক�ো। ওসব একেবারে না ধরেও ত�ো পারবে না। এসব ঘাঁটাঘাঁটি করলে একটু ফুটতে পারে। ঠাকুরপূজ�ো ত�ো র�োজই করবে। একটু ফুটলেই ঠাকুরের চরণামৃত দিও। তবেই সেরে যাবে। যেদিন পেঁপে কেটেছিলে সেদিন কি খেউরি করেছিলে?” বলিলাম, ‘মনে নেই।’ মা বলিলেন, “খেউরিও করেছিলে এবং পেঁপের কষও লেগেছে। দুট�োতে মিলেই ঐ সব হয়েছে।” বিকালবেলা অন্যান্য মেয়েদের কাছে বলিলেন, “ওগ�ো, ত�োমাদের সকলকেই বলছি, ত�োমাদের স্বামী, পুত্র এবং ত�োমরা নিজেরাও নাপিতের নরুন দিয়ে নখ কেট�ো না। এতে অনেক খারাপ র�োগ হতে পারে। এইত�ো ব�ৌমার হাতে এরূপ হয়েছে। অবশ্য ঠাকুরের ইচ্ছায় এ থাকবে না।” সেদিন, একসঙ্গে বসে খাওয়া, এক বিছানায় দুজন শ�োয়া, একজনের কাপড়-গামছা অপরের ব্যবহার করার কত দ�োষ, কি ভাবে একজনের দেহের ভাল বা মন্দ অন্যের দেহে যায় ১৯৭

এইসব বলিলেন।” —(শ্রীমতী ক্ষীরোদবালা রায়, পৃঃ ৩৬০) সংসারে অনেক জনে একসঙ্গে বসবাস করতে হয় কিন্তু কিভাবে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে হয় সে বিষয়ে শ্রীমা প্রয়োজনীয় একটি ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন৷ ক�োন এক ভক্ত মহিলার হাতে ‘ঘা’ জাতীয় কিছু হয়েছে৷ তা দেখে শ্রীমা তার সুরক্ষার বিধান দিতে তা পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ খুব সাধারণ ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রখর৷ আবার এপ্রসঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে ঈশ্বরকে ধরে সংসার করার জন্য আদেশ দিয়েছেন৷ একজনের ব্যবহৃত জিনিস যেমন—শয্যা, গামছা, নাপিতের নুরুন দিয়ে নখকাটা—এইসব সংক্রমনের জন্য এড়িয়ে যেতে বলেছেন৷ কারণ শরীর ও মন ভাল থাকলে তবেই ভগবানের নাম কায়মন�োবাক্যে করা যায়৷ সুতরাং তাকে সুস্থ রাখা খুবই দরকার৷ শরীর অনিত্য হলেও সেই শরীরে শুদ্ধ মন থাকে৷ সেই মনে ঈশ্বরলাভ হয়ে থাকে৷ কিন্তু সঙ্গদ�োষে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, তাই তা থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশ দান৷

১৯৮


হৃদ-মাঝারে শতকমল (৪র্থ পর্ব)

একশ “দুখানা কাপড়ের বেশি ব�োধ হয় জীবনে তিনখানা কাপড় পরেনি। তবু এতেই বেশ আনন্দে আছে। ল�োকের ভাল জিনিসটি ত�োদের চ�োখে পড়ে না। আমি শুনিয়া অবাক হইয়া গেলাম, কম্বলের কথা বা কাপড়ের কথা একদিনও ত�ো মাকে বলি নাই, মা এতটা খবর রাখেন! আমাদের মা যে সত্যিকার মা, ইহা কতবারই না তিনি বুঝাইয়া দিয়াছেন! স্থূলদেহের অন্তরালে গিয়া মা আমার এখন আরও বেশি করুণা বিতরণ করিতেছেন। মাকে এখন যাহারা ডাকে, অন্তর্যামিনী তাহাদের কাছে উপস্থিত হইয়া সকল গ�োল মিটাইয়া দেন। আগে মার কাছে যাইতে হইলে কত য�োগয�োগের দরকার হইত—এখন মনপ্রাণ ঢালিয়া ডাকিলে এক জায়গায় বসিয়াই পাওয়া যায়। মায়ের সন্তান যাঁহারা, তাঁহারা বিপদে পড়িলে তাঁহাকে না ডাকিলেও তিনি যেন নিজের দরকারেই আসিয়া রক্ষা করিয়া থাকেন— এইরূপও কত ঘটনা শুনিতে পাইয়াছি। —(শ্রীমতী ক্ষীরোদবালা রায়, পৃঃ ৩৬৮) মুখে বলতে হয় না, কিন্তু মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারেন অন্তর্যামী শ্রীমা। প্রয়োজন না থাকলেও অযথা দ্রব্য

ক্রয় করে, আবার প্রয়োজন আছে কিন্তু মিতব্যয়িতার কারণে কম খরচে দিনাতিপাত করে এমন অনেক মানুষ আছে। শীতের দিনে একখানা গরম কম্বলের অভাব থাকলেও একজন ভক্তের মনোভিলাষ মাকে বলতে হয় নি, তিনি বুঝতে পারেন৷ শ্রীমাকে কখন�ো না জানালেও তিনি জেনেছেন যে, ঐ ভক্তের বছরে মাত্র দুটি কাপড়েই চলে যায়। শ্রীমা সব জানেন, শুধু প্রয়োজন হলে তবেই উল্লেখ করেন। অযথা কারও মনে কষ্ট দেন না; তবে কিছুর আতিশয্য দেখা দিলে, তিনি তা পছন্দ করতেন না; প্রতিবাদের সুর বেরিয়ে পড়ত। তিনি যে সত্তিকারের মা, তা আর নতুন করে বলে দিতে হয় না। প্রয়োজন মনে করলে তিনি আসেন এবং তাঁর কর্মটি সমাধা করেন। এরকম জগজ্জননীর সাক্ষাৎ পেয়ে ক�োন সন্তান নিজেকে অভাগা ভাবতে পারে? সেই ‘মায়ের চরণে ভরসা কেবল’—এরকম ভাবনা নিয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কাটাতে পারলে বড় আনন্দ হয়। বিপদে সর্বদা রক্ষা করাই শ্রীমায়ের সহজাত ধর্ম। তাই তিনি সবার ‘মা’। বিশ্বজননী৷ শ্রীমা ও তার ভক্ত সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক তাই এত মধুর—যা স্বাভাবিক৷

১৯৯

২০০


Turn static files into dynamic content formats.

Create a flipbook
Issuu converts static files into: digital portfolios, online yearbooks, online catalogs, digital photo albums and more. Sign up and create your flipbook.